পহেলা বৈশাখ বেঁচে থাকুক বাঙালির প্রাণে
আব্দুর রহমান
_____________________
চৈত্রের বিদায় লগ্নে আজ কানে বাজে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিশ্ববিখ্যাত মনজুড়ানো গান,”এসো হে বৈশাখ এসো এসো।” বাঙালিরা যুগযুগ ধরে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পড়ে থেকেও পহেলা বৈশাখের মিস্টি সুঘ্রান গায়ে মাখার অপেক্ষায় থাকে। পহেলা বৈশাখ জাতির একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এই দিনটি বাংলাদেশে ১৪ ই এপ্রিল এবং ভারতে ১৫ই এপ্রিল বেশ ঢাক-ঢোল বাজিয়ে পালন করা হয়। উভয় দেশেই দিনটি সরকারীভাবে পেয়েছে ছুটির স্বীকৃতি। মূলত বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি জায়গায় উৎসবটি বর্নাঢ্যভাবে পালন করা হয়। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই কোন অংশে প্রবাসী বাঙালিরাও। সাধ্যমতো চেষ্টা করে এই দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে। কারণ পহেলা বৈশাখ হলো বাঙালির একমাত্র পরিচয়ের একক। এখানে নেই কোন ধর্ম-বর্নের বা দেশের ব্রাকেট।হিসাব শুধু একটাই “বাঙালি”। গেলো দুইটি বছর বাঙালিদের হিসাবটা পালটে দিয়েছিল করোনা। যে দূর্ভাগ্যের ছোবলে দিশেহারা পরিবেশে আসলে কিছুই করার ছিলনা এ জাতির। তাই ঘরে বসে গুনেছে হতাশার গুটি। তবে এবার বৈশাখ এসেছে বেশ ফুরফুরে অনুভূতি নিয়ে। চারিদিকে মেতে উঠেছে বাঙালি আবার পুরাতন জাগরনে। এই পর্যায়ে অনুভব করতে পারছি, পহেলা বৈশাখের ইতিহাসটা একটু আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ বলতে কিছুই ছিল না। প্রথমে ‘ফসলি সন’ আর পরে ‘বাংলাবর্ষ’ নামে বঙ্গাব্দ শুরু হয় মোগল সম্রাট আকবরের আমলে। তারই নির্দেশে তৎকালীন মশহুর জ্যোতির্বিজ্ঞানী বাংলাভাষী ফতেউল্লাহ সিরাজি প্রথম বাংলা বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করেন। তিনি এটি করেছিলেন সৌর সন আর তখনকার সময়ে প্রচলিত হিজরি সনের ভিত্তিতে। হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে খাজনা আদায় করার রীতি ছিল তখন। সম্রাট যখন দেখলেন চাঁদের ভিত্তিতে হিসাব করা হিজরি সনের কারণে ফসলের মৌসুমভিত্তিক খাজনা আদায়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়, তখনই তিনি নতুন কিছু করার চিন্তা করেন। এ চিন্তারই ফসল বাংলাবর্ষ। সবারই জানা আছে, চাঁদের হিসাবে বছর গণনা করা হলে বছরের হিসাব ১১ দিনের ঝামেলায় পড়ে যায়। ফলে বছরে ফসলের মৌসুমের সঙ্গে মাসের হিসাব মিলে না। এতে কৃষক অন্য মৌসুমে খাজনা দিতে পারেনা। এ সমস্যা দূর হয় বাংলাবর্ষ প্রবর্তনের মাধ্যমে। সম্রাট আকবরের আমলে প্রবর্তিত হওয়ায় তখন থেকেই বাংলা ভূখণ্ডে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। পহেলা বৈশাখে সকলেই মিস্টি বিতরনের চেষ্টা করেন, পুরাতন পাওনা শোধ করে খরিদ্দাররা আবার নতুন খাতা খোলায় ব্যস্ত থাকে। মহাজনরা খরিদ্দারদের হাতে উপহার স্বরুপ তুলে দেন একটি নতুন বছরের ক্যালেন্ডার।
তবে এতো এতো খুশির মুহুর্তে ডিজিটাল যুগে একটু দুঃখ প্রকাশ না করে পারছিনা। আজ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমরা বাংলার চাইতে ইংরেজি নববর্ষকে আপন করে নিয়েছি। যার দায়ভার জাতি হিসেবে অবশ্যই আমাদেরকেই গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি বিবেকের দুর্বিন দিয়ে এসব দেখার এবং বুঝার চেষ্টা করি তাহলে অবশ্যই দেখতে পারবো।সোনার আলোয় জলজল করা উত্তরসুরীদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যগুলিতে কোন কিছুর কমতি নেই! রাত বারোটা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে ওঠে নববর্ষের ভেঁপু। সকাল বেলা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাঙ্গন থেকে মঙ্গল যাত্রা। এর-ই মধ্যে ২০১৬ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক সেই শোভাযাত্রাটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছ। নানা রঙের আকর্ষনীয় পোশাক,যেমনঃ শাড়ি,লুঙ্গি, পান্জাবী পড়ে নারী-পুরুষরা মেতে ওঠে পহেলা বৈশাখে। খাবারের মেনুতে যোগ হয় বাঙালির ঐতিহ্যগতো কিছু রুচিশীল খাবার। যেমনঃ পানতা,ইলিশ, বিভিন্ন ধরনের ভর্তা,পিঠা-পুলি ইত্যাদি। তবে এছাড়াও ঘরে ঘরে মাংস-পোলাও,বিরিয়ানী, মিষ্টান্ন ইত্যাদি আয়োজনের ধুম পড়ে যায়। এই আয়োজনগুলির মর্মবুঝে বাঙালিদের এসব ঐতিহ্যের প্রতি গর্ভের সহিত আন্তরিক ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাঙালির এই প্রাণের ঐতিহ্যকে। সবচাইতে পহেলা বৈশাখের বড় আকর্ষন হলো শহর থেকে শুরু করে গ্রামে বৈশাখি মেলার আয়োজন। মেলায় বসে বিভিন্ন ধরনের খেলা,নাগর দোলা, বাইস্কোপ ইত্যাদি। বিক্রি হয় বিভিন্ন ধরনের কৃষিশিল্প ও হস্তশিল্প। এসব আকর্ষনীয় জিনিসগুলো পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে মানুষ অনেক আগে থেকেই মনে ফুর্তি নিয়ে প্রস্তুত করা শুরু করে। পাশাপাশি বড়দের সঙ্গে সঙ্গে বয়সে ছোটরাও এসব কিনার জন্য সারাবছর মাটির ব্যাংকে, মায়ের কাছে, বাবার কাছে, দাদুর কাছে নানানভাবে টাকা জমানো চেষ্টা চালিয়ে যায়। অর্থাৎ, মেলা এলে সেসব টাকা নানান কাজে খরচ করে। আর তাইতো মেলা হতে বাড়ী ফিরার সময় হাতে থাকে মাটির ঘটি, পাতিল, কাঠের গাড়ীসহ আরও নানান সরন্জমাদি। আরও থাকে বাতাসা,সন্দেশ, মিষ্টি,গজা ও মুড়িসহ বিভিন্ন খাবারের দ্রবাদি।
এবার পহেলা বৈশাখের কয়েকটি খেলাধুলার আকর্ষনের কথা আলোচনা না করে পারা যায়না। তারমধ্যে সবচাইতে মনে ঝড় তুলে “ঘুড়ি” নামের শব্দটি। নীল আকাশ ভরে যায় ঘুরির বিচরনে। এ যেন পুরো বছরের কষ্টগুলিকে সবাই উড়িয়ে দেয় আকাশ পানে। আর নীচে দাঁড়িয়ে থাকে কষ্টমুক্ত মানুষগুলি। পাখির গানে স্বপ্নে দেখে সবাই সম্মুখে এগিয়ে যাবার.…। আরও একটি খেলার কথা একটু স্মরণ করাতে চাই,সেটা হলো কাবাডি খেলা। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাবাডি হারাতে বসেছে সফটওয়্যার গেমগুলির কাছে। তবে বৈশাখ এলে এখনো গ্রাম বাংলা মেতে ওঠে কাবাডি খেলায়। তাছাড়াও লাঠি খেলার ঐতিহ্যটাও এখনও গ্রামে বৈশাখে লক্ষ্য করা যায়।এই দিন বিভিন্ন জায়গায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঘর-বাড়ীগুলিকে গুছিয়ে সবাই পরিপাটি রাখার চেষ্টা করেন। গ্রামে বাড়ীতে উঠানকে সুন্দর করে গোবর দিয়ে লেপাই করা হয়। সবাই একে অপরের বাড়ীতে আসে পরস্পরের সাথে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। মিডিয়াগুলির পহেলা বৈশাখকে আরও প্রাণবন্ত করেতুলে। শহর থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরগুলি বিশ্বের সকলের কাছে তুলে ধরছে। সারা বিশ্ব উপভোগ করে বাঙালির এই প্রাণবন্ত উৎসব। আর আমরা এটাও জানি মানুষের আর এক পরম বন্ধু হলো খবরের কাগজ। সেই খবরের কাগজে প্রকাশ পায় পহেলা বৈশাখ আসল বৈচিত্র্য, যেমন- পহেলা বৈশাখের ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি এবং করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় উঠে আসে,যা উৎসবটিকে করে তোলে আরও প্রাণবন্ত। এবার উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাঙালির এই ঐতিহ্যবাহী পহেলা বৈশাখ কোনভাবেই হারাতে দেওয়া যাবেনা। আমাদের মনে-প্রাণে সেলাই করতে হবে এই গৌরবমাখা উৎসবটিকে। হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে এর মর্ম। তবু হারানো যাবেনা বাঙালির একটিমাত্র মহা উৎসবের ঠিকানা “পহেলা বৈশাখ”। আর তাই আসুন পৃথিবীর সকল প্রান্তের বাঙালিরা, আজ সকলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে এই বিষয়ে শিক্ষা দেই, “পহেলা বৈশাখ” বাঙালির প্রানের উৎসব ছিল,আছে এবং ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকবে বাঙালিদের প্রাণে।”
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct