এই যুদ্ধ কেবল একটি উপায়ে শেষ হতে পারে ইউক্রেনের বিজয়ের মাধ্যমে। পশ্চিমাদের অবশ্যই ইউক্রেনের সরকার যা চাইবে তা দিয়ে সাহায্য করতে হবে—ট্যাংক, কামান, বিমান, নিষেধাজ্ঞা। এটি কেবল বছরের পর বছর উদাসীনতার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, সেটির ক্ষতিপূরণ হবে। একজন চেচেন হিসেবে আমি ইউক্রেনের জনগণের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। তাদের বিজয় হবে পুতিনের অপশাসনের শিকার প্রতিটি জনগণের বিজয়। এ নিয়ে লিখেছেন লানা স্তেমিরোভা।
চেচচনিয়ানরা জানে মস্কোর আগ্রাসন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে—ইউক্রেনে রাশিয়ার বিজয় হবে রাশিয়ার আগ্রাসনে ভুক্তভোগী সবার বিপক্ষে বিজয়। দখলকৃত ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে রাশিয়ার সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার দৃশ্যগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত না করা আমার জন্য অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসাড়তা কাটিয়ে উঠে আগ্রাসনের শিকার মানুষগুলোর ছবি জুম করে, প্রতিটি মুখ ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে আমার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে :‘তারা আগেও এটা করেছে। তারা আবার এটা করছে।’নির্বিচারে গোলাগুলি, লুটপাট, ধর্ষণ, নির্যাতন ও মৃতু্যদণ্ডের প্রমাণ, সর্বোপরি এই যুদ্ধাপরাধগুলো যে উদ্দীপনা নিয়ে সংঘটিত হচ্ছে, তা বেদনাদায়কভাবে পূর্বপরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে আমার মন আরেকটি ছবির দিকে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটি হলো ১৮ বছর আগে চেচনিয়ার রিগাখয় গ্রামে আমার মা, মানবাধিকারকর্মী নাটালিয়া এস্তেমিরোভার তোলা ছবিটি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, পাঁচটি ছোট ধূসর চেহারার শিশুর মৃতদেহ উচ্চতা অনুসারে সারিবদ্ধভাবে পড়ে আছে, যারা সবাই ছিল ভাইবোন। সবচেয়ে বড় শিশুটি পাঁচ বছর বয়সি, সবার ছোট যমজ শিশু দুটি ১২ মাস বয়সিও ছিল না। ২০০৪ সালের ৯ এপ্রিল রাশিয়ান বোমা হামলায় শিশুগুলো এবং তাদের মা মায়দাত সিন্টসায়েভা নিহত হয়েছিলেন। এ ঘটনা ছিল চেচনিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত অনেকগুলো বিচারহীন অপরাধের মধ্যে একটি। আমার মা আশা করেছিলেন, এই ছবিগুলো চেচেন বেসামরিক নাগরিকেরা কী অবস্হার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে বিশ্বকে সতর্ক করবেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কয়েক বছর পরে এলো তার পালা—কেউ একজন রোদে পোড়া ঘাসে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা তার প্রাণহীন, বুলেটবিদ্ধ দেহের একটি ঝাপসা ছবি তুলেছিল। আমার মায়ের খুনিরা মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটাই চেচনিয়ায় রাশিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের প্রকৃত চিত্র।
১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০৯-এর মধ্যে চেচনিয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়া যে দুটি যুদ্ধ করেছিল, তাতে চেচনিয়ান প্রজাতন্ত্র পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এ দুটি যুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ লোক নিহত এবং ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার লোক নিখোঁজ হয়? ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিন যা অর্জন করতে চাইছেন, তারই একটি অদ্ভুত ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি চেচনিয়ার আজকের এই পরিণতি : নেতৃত্বের বর্বরতার দ্বারা আতঙ্কিত একটি অবরুদ্ধ, পরাধীন জায়গা।মারিউপোল প্রসূতি হাসপাতালে বোমা হামলার আগে, ১৯৯৯ সালে গ্রোজনি প্রসূতি হাসপাতাল ও একটি জনাকীর্ণ বাজারে রাশিয়া বোমা হামলা চালিয়েছিল, সেখানে আনুমানিক ১০০-১২০ জন নিহত হয়। বুচা ও ইরপিনের আগে ৭ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে রাশিয়ান সৈন্যরা সমাশকি শহরে জাচিস্টকা অপারেশন পরিচালনা করেছিল, যার মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষের ওপর অকথ্য ভয়াবহতা প্রকাশ পায়। সৈন্যরা বেসামরিক লোকদের গুলি করে, নারীদের ধর্ষণ করে এবং বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঐ দিন অন্তত ১০৩ জনকে হত্যা করা হয়। এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর :নভিয়ে আলদি, ক্যাটির ইয়ার্ট, কমসোমলস্কয়—অনেক গণহত্যা, অনেক জীবননাশ, যা গণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পুতিনের বর্তমান আচরণ দেখে অনেকেই হতবাক হয়েছেন, যখন তিনি শুরু থেকেই তার কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা প্রদর্শন করেছেন। আরো বিস্ময়কর যে, ক্রিমিয়াকে অবৈধভাবে সংযুক্ত করার পরে রাশিয়াকে কবজিতে চড় মেরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ডনবাসে যুদ্ধ চালানোর সময় ২০১৮ বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। রাশিয়ার দ্বারা ইউক্রেনে যে নৃশংসতা সংঘটিত হচ্ছে, সেটি অনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন এবং সহিংসতার চূড়ান্ত পরিণতি, যেটি কয়েক দশক ধরে উপেক্ষা করা হয়েছিল। এই যুদ্ধ কেবল একটি উপায়ে শেষ হতে পারে ইউক্রেনের বিজয়ের মাধ্যমে। ক্রামতোর্স্কে সাম্প্রতিক রকেট হামলায় যে কয়েক ডজন বেসামরিক লোককে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটি রাশিয়ার পক্ষ থেকে আসা যুদ্ধবিরতির যে কোনো আলোচনা কীভাবে একটি প্রতারণা হতে পারে তার উত্কৃষ্ট উদাহরণ। পশ্চিমাদের অবশ্যই ইউক্রেনের সরকার যা চাইবে তা দিয়ে সাহায্য করতে হবে—ট্যাংক, কামান, বিমান, নিষেধাজ্ঞা। এটি কেবল বছরের পর বছর উদাসীনতার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, সেটির ক্ষতিপূরণ হবে। একজন চেচেন হিসেবে আমি ইউক্রেনের জনগণের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। তাদের বিজয় হবে পুতিনের অপশাসনের শিকার প্রতিটি জনগণের বিজয়।
(লেখক চেচনিয়ান সাংবাদিক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct