রমজানে নাও খোঁজ
মোঃ আব্দুর রহমান
_______________
“কাকু একটু দাওনা।” কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটি চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদের চড়াত করে চড়ের শব্দ বাজলো আনুর গালে। আর মাগরীবের সন্ধ্যার আযানের সাথে ভেসে বেড়ালো ছয় বছরের শিশু আনুর আত্মাফাটা ক্ষুধার অাতর্নাদ। চড়টা অবশ্য বসালেন তার বড় বোন শানু নিজের হাতে। এদিকে ইফতার হজমের প্রতিযেগিতা জমেছে ফুটপাত আর হোটেলগুলিতে। খরিদ্দারের বেশ ভীড় এবারের রোজায়। যদিও ফিরেনী সেখানে মানবতার ছিটেফোঁটা। করোনার দাপট থেকে রমজান মাসটা মুক্ত হতে পারলেও,শেষ রক্ষা পেলোনা আনুদের বাবা। বাবা হারা ছোট ভাই আনুকে জড়িয়ে ধরে বাসায় হেটে চলেছে বড় বোন শানু। ভাইকে নিজ হাতে চড় মারার অাক্ষেপে তার চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরের লোনা জল। মায়ের কথায় বড় শখ করে বাকী ইফতার নিতে এসেছিল চাচা হোসেন মিয়ার দোকানে। নিষেধ করার পর দিতীয়বার ক্ষুধার্ত ছোট্ট আনু চাচার কাছে আবদার করাতেই.…., লজ্জায় এমন কান্ড ঘটিয়ে বসলো শানু! ওদের বাবা মাস দুয়েক আগে করোনার সাথে যুদ্ধ করে বিদায় নিয়েছে। আর নতুন করে ঘরে জন্ম নিয়েছে দুঃখের অজস্র খেজুর কাটা! আগের টাকা শোধ না করতে পারায় বাকী দিলোনা হোসেন মিয়া। তবে এই দোকানটি আনুদের বাবাই তার চাচাকে করে দিয়েছেন। দাঁত নেই বলে আর কদর নেই মুখের। সবাই শুধু নাটকটাই দেখছে যা, ঘটনাটা জানার চেষ্টাও করলোনা কোন দর্শক। আর প্রতিবাদের প্রশ্ন আছে চশমার ফাকে আকাশে। অবশ্য তিনতলায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে নীচে কাদো কাদো দৃষ্টিতে সব দেখলো আনুর বন্ধবি টিকলী। ইটভাটার আগুন জ্বলতে থাকলো বান্ধবীর জন্য ওর শিশু মনটায়। আগে আনুর বাবা মাসে মাসে টাকা পাঠাতো, দিন-রাত চুটিয়ে খুনসুটি হতো মেবাইলে বাবার সাথে। মাঝে মাঝেই লোক মারফত আসতো চুইমগাম আর ক্যাটবেরী। সেসব গল্প এবং মজাগুলির ভাগটাও পেতো বান্ধবি টিকলী। আর এখন খাবারের জন্য দোকান থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফেরৎ আসে আনু! আনুর টিউশুনিও এখন বন্ধ। বড় বোন শানুর কাছেই পড়াটা চালিয়ে নিতে হয়। স্কুলেও আগের মতো নিয়মিত যায় না...।
আজ কোন কথা না বলে,তড়িৎ ঘরে প্রবেশ করে বাবার ছবি বুকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে বললো, “বাবা তুমি ফিরে এসো, আমরা যে আর সইতে পারছিনা”। হোয়াংহো নদীর সকল পানি ঝড়ছে বুঝি আজ শানুর চোখে। বাবার অভাবের রণঘন্টটা বেশ উপলব্দি করতে পারলো চাচার নোনা ব্যবহারে। মায়ের বুঝতে বাকী রইলেনা কিছু একটি ঘটেছে। পরে অবশ্য আনু মাকে সব খুলে বললেন। মা অবাক হলেন, দুই মাসের মধ্যে মানুষগুলির মন পাহাড়ের মতো এবড়ো-থেবড়ো হয়েগেছে দেখে! এক সময় তাদের সবার খুব খুব কদর ছিল এ-বাড়ীতে। এখন স্বামীর দাফনের সঙ্গে কদরটাও কবর হয়েছে। ঠিকভাবে কথাও বলতে চায়না বাড়ীর মানুষগুলি। অথোচো তার স্বামীর টাকাতেই এবাড়ীর আকাশচুম্বী উন্নতি। কিন্তু স্বামীর মুত্যু পর পুরো পরিবারকেই আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। আয় নেই তবে তিনটি পেট আছে এ-সংসারে। অবশ্য এতে বাড়ীর মানুষদের কিছু যায় আসেনা। তিন মা-সন্তান মন খারাপ করে বসে থাকলো। ঘরের আবেশটা পরিনত হলো এক নীরব শসানে।চৈতালি সন্ধ্যার পেঁচার ডাকে ডুকরে কেঁদে ওঠে মায়ের মন। চিন্তার হিমালয় চাপলো মাথায়। আজ আর ঘরে কিছু খাওয়ার নেই। চাউলের টিনটাও বিকাল থেকে না হলেও পঞ্চাশবার হাতনো হয়েগেছে। কোন লাভ হয়নি তাতে। ঢেউটিনের চালের পড়ে বেয়েওঠা লকলকে লাউডগাগুলি পৌষ-মাঘে সহযোগিতা করলেও, চৈত্রে বুড়িয়ে মরে গেছে। পেপে গাছটাও বয়সের ভারে বিদায় নিয়েছে। তাই ছেলেমেয়েগুলির মুখে দেওয়ার মতো কোন ব্যবস্থা মায়ের হাতে জমা রইলোনা। কপাল চাপড়িয়ে নীরবে শুধু কেঁদেই যাচ্ছেন দুঃখীনী মা! হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। উঠবো কি উঠবোনা করেও অনেক কষ্টে উঠেগিয়ে দরজা খুললেন আনুর মা। দরজা খোলা মাত্রই অবাক হলেন, আর মুখে আঁচল চেপে খুশীতে আরও জোরে কেঁদে ফেললেন।দাঁড়িয়ে আছে পাশের বাসার আনুর বান্ধবী টিকলী সাথে টিকলীর মা। হাতে আছে প্লেটে সাজানো ইফতারি, একটি টিফিন বাটি হাতে ঝুলানো,জগে সরবত। আর মুখে আছে এগুলি গ্রহণের আকুতি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct