নো ডলার। নো ডিজেল। নো ইলেকট্রিসিটি। নো ফুড। শ্রীলঙ্কার একজন প্রাক্তন ডিপ্লোম্যাটের কাছে বর্তমানে তার দেশের পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি ওপরের কথাগুলোই বললেন। আর এই ডলার, ডিজেল, ইলেকট্রিসিটি ও ফুড না থাকার ফলে আজ দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছে— প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনের বিক্ষোভ ঠেকাতে। পরিবারতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিণাম ভুগতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে। সেই পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন স্বদেশ রায়। আজ শেষ কিস্তি।
শ্রীলঙ্কার একদিকে রিজার্ভশূন্য, অর্থাৎ অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, অন্যদিকে মানুষ এই সরকারের বিদায় চাইছে—এমনকি যে নেতৃত্ব সরকারে আছে, তারা পরবর্তী সময়ে রাজনীতি করুক, তাও চাইছে না। কারণ, মানুষ গোটাবায়ের পরিবারতন্ত্রেরও অবসান চাইছে। তাই শ্রীলঙ্কার এই সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়। যদিও তাদের সরকার গোটা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে চাইছে এ তাদের শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা। বাস্তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা। সে দেশের অর্থনীতি যেমন সংকটে, রাজনীতিও তার থেকে কম সংকটে নয়। আর এর থেকে বের হয়ে আসার পথ কী? শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কোনো কারণে অপসারিত হলে বা চলে গেলে প্রধানমন্ত্রী ঐ দায়িত্ব পালন করতে পারেন। মানুষের দাবি অনুযায়ী সংবিধানের এই পথে হেঁটে কোনো লাভ নেই। কারণ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই একই পরিবারের এবং সম্পর্কে ভাই। আর সে দেশের মানুষের মূল দাবি পরিবারতন্ত্রের অবসান।
শ্রীলঙ্কান রাজনীতিক ও থিংকট্যাংক শচিন্তা আবে জয়সুরিয়ার মতানুযায়ী, ‘মানুষের দাবি সঠিক। কারণ, গোটা রাজনীতিটাকে ধ্বংস করেছে এই পরিবারতন্ত্র। তাদের পরিবারের রাজনৈতিক জমিদারি কায়েম করার জন্য দেশের অযোগ্য ও সুবিধাবাদীদের তারা রাজনীতিক বানিয়েছে এবং তাদের কেবিনেটে বসিয়েছে।’ অন্যদিকে বিরোধী দল দাবি করছে সবাইকে নিয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করা। শচিন্তা মনে করেন, ‘বিরোধী দলকে নিয়ে এই জাতীয় সরকার করে কোনো লাভ নেই। কারণ, বিরোধী দল যদিও রাজপথে আছে। তারা দাবি করছে সরকারের পতনের। কিন্তু তারা তো জনগণের সামনে তাদের কোনো পরিকল্পনা তুলে ধরতে পারেনি, কোন পথে তারা দেশের বর্তমান এই অর্থনৈতিক সংকট দূর করবে। তারাও বর্তমানে যারা সরকারে আছে, তাদের মতোই। তার পরও সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান এ রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের একমাত্র পথ নতুন পার্লামেন্টে ইলেকশন দেওয়া। নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে গোটাবায়ে পরিবারকে বিদায় না করলে এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হবার মতো রাজনৈতিক শক্তির সেখানে আসার কোনো পথ নেই।’ সেক্ষেত্রে বিকল্প কোনো শক্তির ক্ষমতায় আসার সুযোগ আছে কি না—অর্থাত্ দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তানে যেমন রাজনৈতিক অস্হিরতার সুযোগ নিয়ে বারবার সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এসেছে, শ্রীলঙ্কায় তেমন কিছু ঘটবে কি না? এ প্রসঙ্গে কানাডা প্রবাসী একজন শ্রীলঙ্কান থিংকট্যাংক একটু ঘুরিয়ে উত্তর দেন। সোজাসুজি কিছু বলেন না। তিনি বলেন, ‘আমি না বলতে পারি না। তবে সম্ভাবনা কম, আবার সম্ভাবনা যে নেই—তাও বলব না।’
এ প্রসঙ্গে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সামনে আসে শচিন্তা আবে জয়সুরিয়ার বক্তব্য থেকে। তার মতে, শ্রীলঙ্কার সমস্যা এখন আর চায়না ও ভারতের আধিপত্যের এবং চায়নার ঋণের ফাঁদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন মূল ফোকাস, ‘কলম্বো পোর্ট সিটি’। বাস্তবে ভারত মহাসাগরের অবস্হিত এই কলম্বো পোর্ট সিটি এ মুহূর্তে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ভবিষ্যতে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। এর গুরুত্ব শুধু অর্থনৈতিক নয়, আগামী দিনের সামরিক আধিপত্যেরও। তাই কলম্বো পোর্ট সিটি তৈরিতে যে ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে, এই ডলার ব্যয়ে এবং এর আধিপত্য নিতে চায়নার থেকে এখন পশ্চিমারা অনেক বেশি মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ, আমেরিকার নেতৃত্বে যে ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট হতে চলেছে সেখানে ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই কলম্বো পোর্ট সিটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন এই জোট কোনোমতেই এর থেকে তাদের আধিপত্য অন্য কারো কাছে যাক—তা চাইবে না। তাই পৃথিবী আবার যখন নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধে ঢুকে গেছে সে সময়ে শ্রীলঙ্কার এই বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাকে স্নায়ুযুদ্ধের আগামী দিনের হিসাবে ফেলেই হিসাব করতে হবে। সেখানে কলম্বো পোর্ট সিটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমাধান শুধু ভারত বা আইএমএফ দিয়ে হবে, এমনটি বলা যাচ্ছে না এ মুহূর্তে। বরং কলম্বো পোর্টের আগামী দিনের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব হিসাব করে, পরিবারতন্ত্রের বিদায়, পুনরায় পার্লামেন্ট নির্বাচন—সব হিসাবই মাথায় রাখতে হবে। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct