এহসানুল হক,বসিরহাট,আপনজন: আগামী দিনে নিজেদের জীবিকা বিপন্ন হতে চলেছে বলে আশংকায় দিন কাটাচ্ছেন উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের প্রত্যন্ত এলাকার প্রায় পয়তাল্লিশ হাজার বিড়ি শ্রমিক। এই অভিন্ন কর পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এই শিল্পের মালিকদেরও নাভিশ্বাস উঠছে। কি করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখবেন তার কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না । ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বসিরহাট মহকুমা জুড়ে বিড়ির কাজ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। নিশ্চিত অনাহারে, অর্ধাহারের পথে ডুবতে বসেছে শ্রমিকরা। বসিরহাটের আমিনা বিবি, সেখ কুলসুমদের ঘুম ভাঙে বেশ ভোরে। সংসারের প্রতিদিনের কাজ সেরে, চুলা জ্বেলে শুরু হয় বিড়ি বাঁধা। মজুরির খোঁজ করলে দেখা যাবে ভয়ংকর শোষণের ছবি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার সাধারণত প্রতি বছর দুটো ন্যূনতম মজুরির তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকা অনুসারে প্রতি এক হাজার বিড়ি বেঁধে শ্রমিকদের ২৬৭ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ২০২১ সালে বিড়ি মালিক সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে হওয়া দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী মজুরি ঠিক হয় ২০০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে আরও কম মজুরি পান শ্রমিকরা এমনটাই অভিযোগ তাদের। বসিরহাট সাংগঠনিক জেলার কোনো প্রান্তেই নতুন চুক্তি কার্যকর হয়নি। বসিরহাট মহকুমার হাসনাবাদ ও হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায় খুব বেশি হলে ১৭৫ থেকে ১৮৫ টাকা মজুরি পান শ্রমিকরা। গ্রামে মজুরি কমে কোথাও ১৬০ টাকা, কোথাও ১৫০ এখন। আবার বেশ কিছু গ্রামে হাজার বিড়ি পিছু ১৩০ টাকা মজুরিতেও বিড়ি বাঁধছেন শ্রমিকরা। প্রতিবাদ করলে মালিকের মুনশিরা বলছেন, না পোষালে বিড়ি বেঁধো না; লোকের অভাব নেই। বসিরহাট মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে অভাবের সুযোগ নিচ্ছেন বিড়ি মালিকরা। বাড়তি যন্ত্রণা ‘ছাঁট-পট্টি’। সেটা আবার কী? শ্রমিকরা বলেন মজুরি চুরি করার এক প্রাচীন কৌশল। একজন বিড়ি শ্রমিক হাজার বিড়ি পিছু মজুরি পান। শ্রমিক ও মালিকের মাঝে থাকেন মুনশি বা কনট্রাক্টাররা। মুনশিরা শ্রমিকের পাড়ায় পাতা আর মশলা পৌঁছে দেন। সেদিনই আগে দেওয়া পাতা, মশলা অনুযায়ী বাঁধা বিড়ি বুঝে নেন। সেগুলো সংগ্রহ করে মুনশিরা নিয়ে যান কারখানায়। বিড়ি কারখানা বা ছোট ছোট ইউনিটে বিড়িগুলো প্যাকেটবন্দী হয়। মালিক পক্ষের দাবি, প্যাকেটবন্দি করার সময় দেখা যায় অনেক বিড়িই ভালভাবে বাঁধা হয়নি। সেগুলো নাকি ফেলে দিতে হয়। সেজন্য আগেভাগেই কয়েক মুঠো অতিরিক্ত বিড়ি শ্রমিকদের দিয়ে বাঁধিয়ে নেওয়া হয়, কোনো মজুরি ছাড়াই । বিড়ি শ্রমিক যখন বিড়ি জমা করতে যান, এক হাজার বিড়ির সাথে কোথাও একশো, কোথাও দেড়শো অতিরিক্ত বিড়ি জমা নেওয়া হয়। অর্থাৎ ১১৫০ টা বিড়ি বাঁধলে শ্রমিক ১০০০ বিড়ির মজুরি পান। মজুরি ফাঁকি দিয়ে আদায় করা ছাঁট বিড়িও প্যাকেটবন্দি হয়ে পৌঁছে যায় বাজারে।
বিড়ি বাঁধার কাজ স্বাস্থ্যের পক্ষেও বেশ বিপজ্জনক। বিড়ি শ্রমিক মহল্লার অনেকেই শ্বাসকষ্টে ভোগেন। বিড়ি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের প্রশ্নও অবহেলিত। বিড়ি শ্রমিকদের নব্বই শতাংশই মহিলা। তাঁরা কখনো নিজের বাড়িতে, কখনো পাড়ার মোড়ে দল বেঁধে বিড়ি বাঁধেন। এই শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের কোনো দায়িত্ব নেন না মালিকরা। উত্তর ২৪ পরগনা বসিরহাটের কঠুর, দূর্গাপুর, শ্বেতপুর, খিদিরপুরে, স্বরূপনগর, শাকচুরা, তাল পুকুর, মাখাল গাছা, হিঙ্গলগঞ্জ এই সব লাকার জনসংখ্যর একটা বিরাট অংশ নানা ভাবে নির্ভরশীল এই বিড়ি শিল্পের উপর। এইসব অঞ্চলের প্রধান জীবিকাই হল বিড়ি। গ্রামের দরিদ্র মানুষজন কেন্দু পাতা বা বিড়িপাতা কিনে এবং বিড়ি বেঁধে রোজগার করেন। এটি পারিবারিক শিল্প হওয়ায় বেশীরভাগ জায়গাতেই পুরো পরিবার যুক্ত রয়েছে এই কাজে। শ্বেতপুর, কঠুর, দেভোগ, স্বরূপ নগর, দূর্গাপুরের মত গ্রামগুলির বেশির ভাগ মহিলা বিড়ি শ্রমিকরা বলেন বিড়ি শিল্পে যুক্ত থেকে পরিবার পিছু তারা সপ্তাহে এক হাজার বিড়িতে এখন মালিক ১৭৫ টাকা পান,কোন সময় দুশো থেকে তিনশ টাকা পর্যন্ত রোজগার হয়। বিড়ি শ্রমিকদের আই কার্ড নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বলে জানান তাঁরা। ফলে এই পরিস্থিতিতে সরকার তাদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা না করলে এই শ্রমিকদের পরিবারগুলি নিরন্ন হয়ে যাবে। বসিরহাট মহকুমা এলাকায় কয়েক হাজার শ্রমিক এই কাজে যুক্ত রয়েছেন।তারমধ্যে বেশির ভাগ মহিলারা এই কাজের সাথে যুক্ত । এখন মালিকদের থেকে বেশি সংকটে পড়ছে শ্রমিকরা। সেখানে এই কুটির শিল্পটির অবলুপ্তি ঘটলে হাজার হাজার শ্রমিকের দুর্দশার শেষ থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে সরকার শ্রমিকদের কিছু ব্যবস্থা করেন তাহলে এই শিল্পটি রয়ে যাবে। অন্যদিকে উত্তর ২৪পরগনায় জেলার আইএনটিটিইউসি কোর কমিটির সদস্য কৌসিক দত্ত জানান, আমরা খুব শীঘ্রই আন্দোলন শুরু করব ।কারণ বসিরহাট মহকুমায় কয়েক হাজার মানুষ এই বিড়ি বেধে সংসার নির্বাহ করেন।বাম আমলে এক হাজার বিড়ি বেঁধে ৭২ টাকা পেত।বর্তমান সরকার এসেশ্রমিকরা ২০০ টাকা পাচ্ছে।তিনি আরও বলেন বিড়ি শ্রমিকদের বেশিরভাগ প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় ।কেন্দ্রীয় সরকার বিড়ি শ্রমিকদের প্রতি উদাসীন ।সামগ্রিক ভাবে একটা চরম সংকট নেমে এসেছে বিড়ি শিল্পে। তাই বসিরহাট মহকুমার বিড়ি প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি ও শ্রমিকরা একযোগে এদিন পথে নেমে আন্দোলন করার কথা জানান।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct