মুখোশের আড়ালে ‘ভানু’
সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়
_________________
৪৫ বছরের যুবক ‘ ভানু ‘ পেশায় দর্জি। বাজার থেকে সামান্য দূরে পাড়ার মধ্যে তার দর্জির দোকান। সেদিন ভানুকে দেখলাম, কোনও একটি লড়াকু শ্রমিক সংগঠনের মিছিলের পুরোভাগে হাঁটছে। মিছিল থেকে সমবেত কণ্ঠে স্লোগান উঠছে , “অন্যায়, অত্যাচার মানব না, শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে গর্জে উঠব ,অন্যায় নিজেরাও করি না, অন্যায়কে সহ্যও করব না “ ইত্যাদি।ভানুও তাতে বেশ জোরের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে । মিছিল এক জায়গায় থেমে যাওয়ার পর ওই মিছিলের নেতা তাঁর বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন। তিনি বলতে লাগলেন, “ সরকার এবং সাধারণ মানুষ অবহেলিত, গরিব কামার, দর্জি, ছাপাখানা, গ্রিল, আলমারি কারখানা, লেদ মেশিন ইত্যাদি জায়গার শ্রমিকদের কথা ভাবে না। এইসব জায়গার শ্রমিকরা যথেষ্ট গরিব, এদের অনেক সমস্যা আছে” --- ইত্যাদি। ভানুর দোকানে গেলে শোনা যায় যে, সে বলে, “ আজকাল এই দেশে গরিবদের জন্যে কেউ চিন্তা করে না , না সরকার, না সাধারণ মানুষ। বড়লোকদের নিয়েই সবার মাথাব্যথা ,গরিব যেমন অবহেলিত রয়েছে ,তেমন অবহেলিতই থেকে যায়। আসলে ন্যায় নীতি বোধটাই এখানকার মানুষের মধ্যে নেই , কমজোরকে সবাই অবহেলা করে “---- ইত্যাদি। ১৪ বছর বয়সী কাসেম আলি তার বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। কাসেমের মা লোকের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে। হতদরিদ্র এই পরিবারের ছেলে কাসেম একটু বেলার দিকে বাজারে গিয়ে কয়েকজন সব্জী বিক্রেতার দোকান গুছিয়ে দেয়, দোকান আর দোকানের সামনেটা পরিষ্কার করে দেয়। তারপর আবর্জনাগুলোকে দূরে ফেলে দিয়ে এসে সব্জী ওয়ালাদের থেকে খুব সামান্য কিছু পয়সা পায়।
ভানুর বাড়ির সামনে দিয়েই কাসেম রোজ বাড়ি যায়। ভানু এক এক দিন বাজারে গিয়ে কিছু সব্জী কিনে কাসেমকে দিয়ে বলে, “ বাড়ি যাবার সময় এগুলো আমার বাড়িতে পৌঁছে দিস “। কাসেম তা’ই করে কিন্তু এজন্য ভানু কাসেমকে কিছূই দেয় না। ভানুর যুক্তি , “ আমার বাড়ি তো কাসেমের বাড়ি যাবার পথেই পড়ে, এজন্য আবার আলাদা করে ওকে কি দিতে হবে “?সেদিন ভানুর দোকানে গিয়ে কাসেম একটা জামা কাপড় নেবার ক্যারিব্যাগ চাইতে ভানু গর্জে উঠল, “ তুই আবার ক্যারিব্যাগ নিয়ে কি করবি “? একটা চড় দেখিয়ে বলে উঠল,” বেরও এখান থেকে ,যত সব উল্টোপাল্টা আবদার “। ক্ষুণ্ণ মনে কাসেম ওখান থেকে চলে গেল। এই ঘটনার মিনিট দশেক বাদে ভানুর দোকানের সামনে দিয়ে যাবার পথে, একটা চলন্ত দামি চারচাকা মোটরগাড়ি থামিয়ে, ওই গাড়ির আরোহী একজন সুবেশা ৬০ – ৬২ বছর বয়সী ভদ্রমহিলা ভানুর কাছে একটা ক্যারি ব্যাগ চাইলেন। বিনা বাক্যব্যয়ে ভানু ওই ভদ্র মহিলাকে একটা নতুন ও চকচকে ক্যারিব্যাগ দিয়ে বলল, “ হবে তো, না আরও বড় চাই”? ক্যারিব্যাগটা নিয়ে খূশী মনে তিনি চলে গেলেন। ভদ্রমহিলা স্থানীয় নন আবার ভানুর খদ্দেরও নন, তবু ভানু তাঁকে এই খাতির করল।
ভানু তার দোকানে নতুন জামা প্যান্ট বানানো এবং মেরামত দুই-ই করে। সেদিন ‘অভীক নামের’ ১৫ – ১৬ বছরের এক কিশোর একটা প্যান্ট নিয়ে কিছু মেরামত কাজের জন্য ভানুর দোকানে এলো। ভানু মেশিনে বসে কাজ করছিল। অভীক যতবারই ভানুকে কাজটা দেখাতে চায় আর বলে, “ কাকু কাজটা একটু দ্যাখো “ , ভানু ততবারই হয় সাড়া দেয় না অথবা ঝাঁঝিয়ে বলে, “ অত তাড়া কিসের , দোকানে এসে একটু অপেক্ষা করতে পারা যায় না “? অভীক দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই একজন বয়স্ক লোক ভানুর কাছে একটা প্যান্ট এনে ,সেটাতে কি কাজ আছে দেখতে বললেন। ভানু তাড়াতাড়ি এসে কি কাজ বুঝে, প্যান্টটা নিয়ে আবার তার মেশিনে ফিরে গেল। অভীক দাঁড়িয়েই রইল।অভীক কাতর স্বরে বলল, “ কাকু, তুমি আমার কাজটা দ্যাখো, আমি তো কত আগে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি “। ভানু এবারে বিশ্রী ভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “ কানের কাছে একটানা কি ভ্যানভ্যান করে চলেছিস , দোকানে এলেই কি তোদের যত তাড়া, আশ্চর্য “? ঘটনাটা কোনও কল্পকাহিনী নয় বরং একবারে একশো ভাগ সত্য ঘটনা। ভানুর প্রতিবাদী তথা সংগ্রামী রূপটা মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু ওই প্রতিবাদী তথা সংগ্রামী চরিত্রের পাশে কাশেম এবং অভীকের সাথে তার আচরণটা কি মানায় ? তাছাড়া, কাসেম এবং অভীকের সাথে তার আচরণটা মানুষের নজরেও আসে না। আর নজরে এলেও সেটার অবাঞ্ছিত দিকটাকে উপলব্ধি করার মত ক্ষমতাও বেশি ভাগ মানুষেরই থাকে না। ফলে এসবের কোনও প্রতিবাদও হয় না। আমাদের দেশের অজস্র মানুষেরই স্বভাব ও আচরণ এই কাহিনীর ভানুর মত। কবে হবে এর পরিবর্তন ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct