দিন শেষের হিসাব
অশোক কুমার হালদার
_______________________
প্রকৃতির এই বিস্ময়কর সৃষ্টি জগতে যেমন প্রকৃতি মায়ের নিজ হিসাবের খাতা থাকে তেমন নিশ্চয়সূচক এবং স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রমাণসিদ্ধ, র্নিভুল এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কাল পর্যায়ক্রম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রকৃতির হিসাবের খাতায় নিয়ত্রিত হয়। যেমন প্রকৃতির হিসাবের খাতায় রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত আগমন এবং ফিরে যাওয়া।প্রকৃতির হিসাবের খাতায় যেমন আঁধার আছে তেমনি আবার জোৎস্না আছে। যেমন দিন আছে তেমনি প্রমাণসিদ্ধ র্নিভুলভাবে রাত্রি আসবে। তদ্রুপভাবে প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ হিসাব থাকে। যারা শ্রমজীবি মানুষ তাদের প্রতিদিনের কাজকর্মের শেষে তাদের মনের খাতায় দিনের হিসাবনিকাশ নিজের মনের, খাতায় লিখে রাখে। রামরতন বর্মন নদীয়া জেলার পলাশী পাড়ায় বাড়ি। তিনি শিক্ষিত মানুষ চাকুরী জীবি ছিলেন। এখন তিনি অবসর নিয়েছেন চাকুরি থেকে। রামরতন বাবুর চাকরী জীবনের শুরু থেকেই ডায়্যারি বা দিন পঞ্জী খাতা ব্যবহার করতেন। আর সেই খাতায় প্রতিদিনের কাজকর্মের ফাইফরমাস, সংসার পরিবারের প্রতিদিনের খরচ এবং সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি কী, কী কাজ করলেন এবং কোন কোন বিশেষ ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে দিনটি অতিবাহিত হয়ে গেল তার পুঙ্খাপুঙ্খানু হিসাব তার রোজ নামচা খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। সন্ধ্যা বেলায় রামরতন বাবুব বন্ধু সুধীর সরকার বৈঠকখানায় এসে হাজির হতেন দৈনন্দিন জীনের পারিবারিক ক্রম বিকাশ এবং আয় উন্নতি অভাব অভিযোগ এবং জীবনের হতাশা। এইসব নিয়েই সার্বিকভাবে আলাপ আলোচনা চলতো। কারণ সুধীর বাবু নিজেও একজন অবসর প্রাপ্ত মানুষ। তিনিও স্বাস্থ্য দপ্তরে চাকুরীরতা ছিলেন এক সময়। আলাপ আলোচনার মধ্যে দুজনেরই সময়টা ভালোই কেটে যেত। রাত্রি নয়টা বাজার আগেই রামরতন বাবুর বৌমা অর্থাৎ ভাইয়ের বৌ রাখি দুই কাপ চা নিয়ে এসে বলতো দাদা চা। রামরতন বাবু তখন বলেতন তুমি আর কত সেবা এই বুড়োদের করবে বৌমা। তখন বৌমা রাখি দাদাদের উদ্দশ্যে বলতো এ-আর কীসের সেবা দাদা। রামরতন বাবু তখন বলতেন তোমাদের কাছে আমি ঋণী হয়ে যাচ্ছি। ওদিকে আবার রামরতন বাবুব ভাইয়ের গলা শুনে বৌমা চা দিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। তখন সুধীর বাবু চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে রামরতন বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন কার গলার স্বর বলছিলে ভাই রামরতন। রামরতন তখন বললেন ওটা ভাই গয়ানাথের গলার স্বর। ওর এখন দীঘায় মাছের আরত আছে। সমুদ্রের মাছ কেনা বেচার ব্যবসা করে। আমার স্ত্রী বেঁচে থাকতে গয়ানাথ স্থানীয় বাজারের আরতদার ছিল। অনু ওকে বলেছিল বাইরে ব্যবসা করার থেকে স্থানীয় জায়গায় ব্যবসা করা ভালো। অনুই ছোট ভাইকে বাইরে যেতে দেয়নি। কিন্তু অনু আজ সাত বছর হল গত হয়েছে। তারপর থেকেই ভাই গয়ানাথ এখন দীঘায় যায় ব্যবসা করতে। সুধীর বাবু তখন রামরতন বাবুকে বলছিলেন যে তোমার দেখছি সব মনে আছে। কারণ এই বয়সে সাধরণত স্মৃতির আরালে পুরোনো স্মৃতি হারিয়ে যায়। কিন্তু তোমার দেখছি এখন সব ছবির মতো মনে আছে। মনে কী আর এমনি আছে, এই দেখো আমার এই দিন পঞ্জী হিসাবের খাতা আমার স্মৃতির পাতা থেকে আমার মনে নাও আসতে পারে এই বয়সে। সেই জন্যই এই দিন পঞ্জীর খাতা আমি বহুদিন ধরে ব্যবহার করে আসছি। সুধীর বাবু তখন আবার রামরতন বাবুকে বললেন যে আমিও একসময় এই রোজনামচা বা দিন পঞ্জীর খাতা ব্যবহার করতাম। কিন্তু ঐ খাতা শুধু মানুষের মনে ভুলে যাবার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তুমি যতই পুরানো হিসাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বর্ণনা করে, তাতে মনের আগুন নিভে না বরং বেড়ে যায়। তাই আমি ঐ দিনপঞ্জী খাতা ব্যবহার উপযোগী মনে করি না। এতে মনের বর্তমান শান্তি বিঘ্নতী হয়। জীবনের হিসাব মেলে না। সুধীর বাবু আরোও বলছিলেন ভাই রামরতন ভূত বা বর্তমান এক হয় না। কারণ অতীতকালকে আমরা ভূতকাল বলি, বর্তমানের সঙ্গে তার কোন মিল থাকে না। কারণ আমার মতে ভূত কালটি আবর্জনা ইত্যাদি পোড়াইয়া ভস্ম করিবার একটি চুল্লী বিশেষ। যারা বুদ্ধিমান তারা কেবল বর্তমান কালকে উপযোগী মনে করেন। কারণ অতীত যত ভালোই হোক তবুও অতীত সেটা বর্তমান বা ভবিষ্যত নয়। অতীতের নিদারন ঝরে সখের বাগান থেকে সব থেকে মূল্যবান বৃক্ষটি যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে বাগনের মালিক খুব দুঃখ- কষ্ট পায় ঠিকই কারণ যেটা মন থেকে মুছে ফেলা যায় না কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম ধীরে ধীরে মনের মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ মানুষের মন হচ্ছে অস্থিতি স্থাপক কিছুদিন পরেই মনের গভীরে ঘটনা প্রবাহ অন্তরধ্যান হয়ে যাবে। তখন মন আবার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে। এই সব কথা শুনে রামরতন বাবু বলছিলেন যে তাহলে আমি কেন বা আমার মন কেন পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসছে। শুধু মনের ভেতরে কেবলমাত্র পূর্বের স্মৃতিগুলি উঁকি ঝুঁকি মারছে। এই কথা শুনে সুধীর বাবু, তার বন্ধু রামরতন বাবুকে বলছিলেন যে এটা তোমার নিজের কর্মের দোষেই ঘটছে কারণ পুরোনো স্মৃতি। মনের গভীর অন্তরধ্যানে হওয়ার আগেই তুমি তোমার দিন পঞ্জীর খাতায় চোখ বোলাচ্ছ আর যার কারণেই তোমার পুরোনো স্মৃতিগুলি তোমার মনের দর্পনে বারবার ভেসে উঠছে।আর তুমি মন কষ্টে অধীর হয়ে পড়ছো। তোমার প্রথম কাজ এখন দিন পঞ্জীর খাতার হিসাবে এখন ছেড়ে দাও। মনে শান্তি পাবে। মন ব্যাকুল হবে না। তাছাড়া তুমি তো ভাগ্যমান মানুষের কারণ তোমার একটা মাত্র কন্যা, তার বিয়েও হয়ে গেছে অনেকদিন হলো এবং তোমার মেয়ে এবং জামাই দুইজনই ডাক্তার তোমার মেয়ে কবিতা আগাগোড়ায় লেখাপড়ায় ভালোই ছিল। আর যার কারণে সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের মধ্যে মানুষের মতো মানুষ হয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার হতে পেরেছে এবং সমাজ সেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছে। আর তোমার মেয়ে কবিতার বিয়ে দিয়েছো একজন ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে। আর তোমার মন খারাপ হলে মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি গিয়ে দুদিন ঘুরে এসো। তাহলে বায়ুরও পরিবর্তন হবে এবং মনটা ভালো হবে। তবে হ্যাঁ দিন শেষের হিসাবের খাতা একজন অবসর প্রাপ্ত চাকুরী জীবির জন্য কিন্তু ঐ দিন পঞ্জী হিসাবের খাতার কোন প্রয়োজন থাকতে পারে না। জীবনের হিসাব কোনদিনই ঐ হিসাবে থেকে পাওয়া সম্ভবপর নয়। তবে ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কেনা বেচা এবং লাভ লোকসানে একটা হিসাবের খাতা থাকে। বিশেষ ভাবে প্রয়োজন যেটা তোমার ভাই গয়ানাথের ক্ষেত্রে মাল কেনা ও বেচার হিসাব অবশ্যই রাখতে হবে। কারণ কত টাকায় মাছ খরিদ করে এবং কত টাকায় সেটা বিক্রয় হলো। সাময়িক ভাবে খাতায় হিসাব না রাখলে, কত টাকায় কিনলো আর কত টাকায় বিক্রয় হলো। আর এতে কত লাভ না ক্ষতি সেটা জানার জন্য এই হিসাবের খাতার প্রয়োজন হয়। এবার রামরতন বাবু তার বন্ধু সুধীর বাবুকে বলছিলেন, সব তো আমার কথাই এতক্ষণ হলো। তাহলে তোমার বর্তমান খবরটা এবার বলো।সুধীর বাবু বলছেন ভাই আমার ছেলে ও বৌমাতো চাকরীর সুবাদে অনেকদিন হলো বাহিরে রয়েছে। আর আমার স্ত্রী এখন বাড়িতে একা সহায় সম্বলহীন ভাবে থাকে। স্ত্রীকে আমার এই বয়সেও সাহায্য করতে হয়। কারণ তার বাতের ব্যাথায় কখন কখন অধীর হয়ে পড়ে। তখন সে বিছানায় পড়ে থাকে। তাকে তখন ওষুদ পত্র এবং সেবা শুশ্রষা করতে হয়। এমনকি ঘরে রান্নাও করতে হয়। কারণ নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য বোধের খাতিরে। এই সংসারে বাধা, ব্যাঘাত এবং বিস্মৃতির আকাশে সংসার জীবন ঢাকা আছে সেটা দিন পঞ্জীর খাতার হিসাবে মেলে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct