ইউরোপ যদি বিশ্বমঞ্চে একটি কৌশলগত খেলোয়াড় হয়ে ওঠে, তবে এটি এই ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উদার মূল্যবোধের সমর্থনে পৃথিবীতে একটি সুপার জোট তৈরি হবে। কিন্তু পশ্চিমাদের নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছে, তা হল তাদের ইউক্রেনে অবশ্যই সফল হতে হবে। তা নিয়ে লিখেছেন ফরিদ জাকারিয়া। আজ শেষ কিস্তি।
জ্বালানির ক্ষেত্রেও আমরা সম্ভবত একটি নতুন জগতের মুখোমুখি হচ্ছি, যেখানে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম থাকবে আকাশচুম্বী। এর অর্থ হলো, যে দেশগুলো হাইড্রোকার্বন উত্পাদন করে, আগামী দশকে তাদের প্রচুর নগদ অর্থ তথা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। (ভ্লাদিমির পুতিনের রাজস্বের প্রধান উত্স তার সস্তা তেল ও গ্যাস। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এই তেল-গ্যাস শিল্প কেন বন্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ, তা সহজেই বোধগম্য।) ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের মতো তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো বিশ্বের উদ্বৃত্ত মূলধনের বিশাল উত্স হয়ে উঠবে।
নতুন যুগের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো এটি হবে পোস্ট-আমেরিকান যুগ। এর দ্বারা আমি বলতে চাই যে, গত তিন দশকের প্যাক্স আমেরিকান যুগ শেষ হয়ে গেছে। আপনি সর্বত্র এর লক্ষণ দেখতে পারেন। ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের খবর অনুসারে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের নেতারা কয়েক দশক ধরে তাদের নিরাপত্তার জন্য ছিল ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভরশীল। এমন দুটি দেশ আজ এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফোন ধরতেও অস্বীকার করে। পাশাপাশি বিবেচনা করুন এই বাস্তবতা যে, ইসরাইল ও ভারত পুতিনের পদক্ষেপকে আক্রমণ হিসেবে বর্ণনা করতে অস্বীকার করেছে এবং এই চারটি দেশই স্পষ্ট করেছে যে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাবে। প্রথমত মনে হতে পারে, এটি আমেরিকার প্রতিকূলে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা। তবে আসলে তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের নেতৃস্থানীয় শক্তিই রয়ে গেছে, এখনো পর্যন্ত বাকি সব শক্তি থেকে এককভাবে শক্তিশালী। এই নতুন যুগের কিছু বৈশিষ্ট্য থেকেও আমেরিকা উপকৃত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হাইড্রোকার্বন উত্পাদনকারী দেশ। জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে চীন ও জার্মানির মতো দেশগুলোর জন্য ভয়ংকর পরিস্হিতি তৈরি হবে। নিজে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ অঞ্চলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। বরং তা উত্পাদন বৃদ্ধিকে আরো উদ্দীপ্ত করবে। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ভূরাজনৈতিকভাবে ওয়াশিংটনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে একটি বেকায়দা অবস্থায় ফেলেছে। বেইজিং রাশিয়ার ক্রিয়াকলাপকে সমর্থন করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তার বিরোধ বাড়ছে। অথচ চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কঠোর চেষ্টা করেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কৌশলগত সুযোগ তৈরি হয়েছে ইউরোপের জন্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কয়েক দশক ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা ইউরোপ এখন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ে পরিণত হতে পারে। আমরা এখন তার কিছু লক্ষণও দেখতে পাচ্ছি। যেমন—ইউরোপীয়রা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে এবং ন্যাটোর পূর্ব সীমান্ত সুরক্ষিত করে আমেরিকা থেকে পাওয়া বিনা মূল্যের নিরাপত্তা যুগের অবসান ঘটাতে প্রস্তুত হচ্ছে। জার্মানির অসাধারণ পরিবর্তন দিয়ে এর শুরু হয়েছে। এভাবে ইউরোপ যদি বিশ্বমঞ্চে একটি কৌশলগত খেলোয়াড় হয়ে ওঠে, তবে এটি এই ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। একটি কেন্দ্রীভূত ও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উদার মূল্যবোধের সমর্থনে পৃথিবীতে একটি সুপার জোট তৈরি হবে। কিন্তু পশ্চিমাদের নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছে, তা হলো তাদের ইউক্রেনে অবশ্যই সফল হতে হবে। সেজন্যই এই মুহূর্তের জরুরি কাজ হলো ব্যাপক ব্যয় ও ঝুঁকি বহন করে হলেও পুতিন যাতে বিজয়ী না হয়, তা নিশ্চিত করা।
(সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct