ইউরোপ যদি বিশ্বমঞ্চে একটি কৌশলগত খেলোয়াড় হয়ে ওঠে, তবে এটি এই ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উদার মূল্যবোধের সমর্থনে পৃথিবীতে একটি সুপার জোট তৈরি হবে। কিন্তু পশ্চিমাদের নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছে, তা হল তাদের ইউক্রেনে অবশ্যই সফল হতে হবে। তা নিয়ে লিখেছেন ফরিদ জাকারিয়া। আজ প্রথম কিস্তি।
ইউরোপ যদি বিশ্বমঞ্চে একটি কৌশলগত খেলোয়াড় হয়ে ওঠে, তবে এটি এই ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। একটি কেন্দ্রীভূত ও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উদার মূল্যবোধের সমর্থনে পৃথিবীতে একটি সুপার জোট তৈরি হবে। কিন্তু পশ্চিমাদের নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছে, তা হলে তাদের ইউক্রেনে অবশ্যই সফল হতে হবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ পৃথিবীতে একটি ভূমিকম্পের মতো ঘটনা। জার্মানির বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নিঃসন্দেহে। এই যুদ্ধ একটি যুগের যবানিকাপাত ঘটিয়েছে। তবে আমরা নতুন যে যুগে প্রবেশ করছি, সে ব্যাপারে আমরা কী বলতে পারি? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই যুগকে অর্থনীতির ওপর রাজনীতির বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। গত তিন দশক ধরে অধিকাংশ দেশের চলার পথের নীতি ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তারা বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও অভ্যন্তরীণ সংস্কারের নীতি গ্রহণ করেছে, যার মূল কথা হলো আরো উত্পাদন বৃদ্ধি। এ ধরনের নীতির প্রতি জোর দেওয়া সেই সব দেশেরই সম্ভব, যেসব দেশে জাতীয় নিরাপত্তার মতো মূল ইস্যু নিয়ে তেমন কোনো উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা নেই। কিন্তু কানাডা থেকে জার্মানি-জপান প্রভৃতি উন্নত দেশ, যারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেকটা নিশ্চিত, তারাও আজ তাদের প্রতিরক্ষা নীতি ও নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে।
রাজনীতি যেভাবে অর্থনীতিকে টপকে যাচ্ছে, তার একটি মাত্র অংশ সামরিক নিরাপত্তা। দেশগুলো তাদের সরবরাহ চেইন ও অর্থনীতিতে আরো বিস্তৃতভাবে বৃহত্তর জাতীয় নিরাপত্তার অনুসন্ধান করছে। এই প্রবণতা কয়েক বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে। ব্রেক্সিট থেকে ‘আমেরিকার পণ্যই কেবল কিনুন’ আইন পর্যন্ত অনেক মুক্তবাজার দেশের গৃহীত নীতিগুলো মূলত বাজার অর্থনীতির চেয়ে লোকরঞ্জনবাদী জাতীয়তাবাদ দ্বারা বেশি প্রভাবিত। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজ দেশের খাদ্যের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বন্ধ করতে নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় তিন বলেন, ‘চীনা খাবারের বাটিগুলো’ ‘প্রধানত চীনা খাবার দ্বারাই পরিপূর্ণ’ হওয়া উচিত। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আমরা এখন বিশ্বায়নের ৩০ বছরের উলটোটা দেখতে পাচ্ছি। উদাহরণস্বরূপ, এই তিন দশক ধরে আমেরিকান কোম্পানি ম্যাকডোনাল্ডস রাশিয়ায় একটি বড় ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করেছে, কৃষক ও সরবরাহকারীদের ব্যাপক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। প্রায় ৮৫০টি রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে এবং একটি বিশাল গ্রাহকশ্রেণি তৈরি করেছে তারা। যুদ্ধের কারণে সেই সব রেস্তোরাঁ এখন বন্ধ রয়েছে এবং স্থায়ীভাবে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রাশিয়ান এয়ারলাইনস এরোফ্লট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নিজেদের পুনর্গঠিত করেছিল। এখন এই কোম্পানি বোয়িং ও এয়ারবাসগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রি করতে বা প্লেনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে অস্বীকার করছে। এমনকি এই কোম্পানি বিদেশের বিভিন্ন রুটে ফ্লাইটও বন্ধ করে দিতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষা ও স্বনির্ভরতা অর্জন। এটি বিশ্বের সর্বত্র পণ্যমূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যেহেতু দেশগুলো স্থিতিস্থাপকতার সন্ধান করছে এবং বিদেশের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা থেকে সরে আসছে, তাই যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহে ধাক্কাটা আপাতত সাময়িক বলে মনে হলেও এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি নতুন বিশ্বের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct