পোল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া ইউক্রেনের শরণার্থীর সংখ্যা এখন ২১ লাখ ছাড়িয়েছে। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেন যে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেছে, তাতে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো। অস্ত্রশস্ত্রের চালানের একটি অংশ আসছে পোল্যান্ড হয়ে। ন্যাটোভুক্ত দেশ পোল্যান্ডের সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি ইউক্রেনের সামরিক ঘাঁটিতে রুশ বিমান হামলা বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। তা নিয়ে লিখেছেন এ কে এম জাকারিয়া। আজ শেষ কিস্তি।
বিশ্বের প্রধান ব্যবসাগুলোকে মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করেন অনেকে। অস্ত্র, ওষুধ ও জ্বালানি তেল (গ্যাসও)। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অস্ত্র বেচতে দরকার যুদ্ধ। ওষুধ বেচতে ওই শিল্পের দরকার রোগ-মহামারি। আর তেল কোম্পানিগুলোর দরকার যেকোনোভাবে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমিয়ে দাম বাড়ানো ও বেশি মুনাফা করা। যুদ্ধ অস্ত্রের চাহিদা ও বিক্রি বাড়ায়, আবার সেই যুদ্ধ যদি তেল উৎপাদনকারী দেশ বা অঞ্চলে ঘটে, তবে তেলের দামও বাড়ে। যুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বের তিনটি প্রধান ও বড় ব্যবসা খাতের দুটির স্বার্থই সরাসরি যুক্ত। যুদ্ধকে ‘ব্যবসাবান্ধব’ হিসেবে মেনে না নেওয়ার উপায় আছে কি!
বাণিজ্য বা ব্যবসার স্বার্থ মাথায় নিয়েই যেকোনো দেশ তার আন্তর্জাতিক নীতি বা কৌশল গ্রহণ করে। যুদ্ধ যখন ব্যবসাবান্ধব, তখন যুদ্ধ লাগানোকে কোনো দেশ অর্থনৈতিক স্বার্থে কৌশল হিসেবে নেবে, এটাই তো স্বাভাবিক। পররাষ্ট্র, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে নজর রাখেন আমেরিকান ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু জে বাচেভিক। যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে; যুক্তরাষ্ট্র অনন্ত যুদ্ধে জড়িয়ে আছে, কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট ঠিক এটাই চায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙা করেছে। যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি ও এসবের ফরমাশ পেয়ে দেশটির শিল্প খাত তখন ফুলেফেঁপে ওঠে। জিডিপি বাড়ে, কমে যায় বেকারের সংখ্যা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ যুদ্ধবাণিজ্য এক বড় অভিজ্ঞতা হিসেবে হাজির হয়। অস্ত্রশিল্প হয়ে ওঠে দেশটির অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত। ‘অনন্ত যুদ্ধে’ জড়িয়ে থাকা তাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা অর্থনীতি চাঙা করার একটি কৌশল হিসেবেই একে গ্রহণ করেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এবং সামরিক জোট হিসেবে এর সম্প্রসারণ ও শক্তি কমানোর নীতি নিয়ে এগোচ্ছিল ফ্রান্স ও জার্মানি। যুক্তরাষ্ট্রের তা ভালো লাগার কথা নয়। এসআইপিআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর প্রথমবারের মতো ২০২০ সালে বিশ্বে অস্ত্র খাতে সবচেয়ে বেশি খরচ বেড়েছে। ন্যাটো দেশগুলোরও বেড়েছে। এখন ইউক্রেন সংকট সবকিছুকে বদলে দিয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীলতা অনেকটা আগের জায়গায় চলে আসতে শুরু করেছে।
ইউক্রেন সংকট বিশ্বজনমতকে প্রায় সাদা-কালোয় ভাগ করে ফেলেছে। রাশিয়া বা পুতিনের সমর্থকেরা যুক্তি দেন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো রাশিয়ার পেটের মধ্যে ঢুকে পড়তে উদ্যত হওয়ায় ইউক্রেনে হামলা না চালিয়ে রাশিয়ার আর কোনো উপায় ছিল না। ফলে এ যুদ্ধের দায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমর্থক। এ যুক্তি মেনে নিলে ধরে নিতে হবে রাশিয়া পশ্চিমের ফাঁদে পা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধ দরকার হয়ে পড়েছিল এবং রাশিয়া তা উপহার দিয়েছে। হিসাব করার বিষয় হচ্ছে, এতে চূড়ান্ত বিচারে লাভবান হচ্ছে কোন পক্ষ? ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বিশ্বে সবচেয়ে বড় যে সর্বনাশ ঘটিয়েছে, তা হচ্ছে বড় প্রতিবেশীর পাশে থাকা ছোট দেশগুলোর বিশ্বাস ভেঙে দেওয়া। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী সত্যিই ঢুকে পড়বে, এটা ঘটনা ঘটার আগপর্যন্ত অনেকেই বিশ্বাস করেনি। বড় প্রতিবেশীর পাশে থাকা ছোট দেশগুলো এখন আরও সতর্ক হবে, অস্ত্র কেনায় মন দেবে। ইউক্রেনে যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলুক বা দ্রুত শেষ হোক, রাশিয়ার ঘটানো এ ‘সর্বনাশ’ সামনে নিশ্চিতভাবেই অস্ত্র ব্যবসার রমরমা সময় উপহার দিতে যাচ্ছে। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct