[বিন্দু বিন্দু জল যেমন নির্মাণ করে সিন্ধু। তেমনই ছাত্র জীবনের শুরু থেকে সু-চিন্তার উন্মেষ ও অভ্যাস কানায়-কানায় ভরিয়ে দেয় জীবন। রবীন্দ্র রচনার নানা অংশ দিয়ে সদ্য মাধ্যমিক দেওয়া পরীক্ষার্থীদের জন্য কলম ধরেছেন সুলেখক তাপস মুখোপাধ্যায়। তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশে থাকেন।]
জীবনকে মূলত তিন প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। ছাত্র জীবন, কর্ম জীবন এবং অবসর জীবন । ছাত্র জীবন হল জীবনের গঠন মূলক সময়, জীবনের পরম লগন । এই সময় বৃথা কাটানো উচিত নয়। কবির ভাষায়, "জীবনের পরম লগন কর না হেলা, বৃথাই কাটিবে বেলা, সাঙ্গ হবে যে খেলা" ।বাড়ি তৈরির আগে যেমন নকশা বানানো জরুরি, জীবনের শুরুতে শেষের দিকটা ভেবে দেখাও ঠিক সেইরকম জরুরি। জীবনের শেষে ঠিক কেমন করে রাঙাতে চাই পশ্চিম দিগন্তকে তা ঠিক করতে হবে ছাত্র বয়সেই । তারপর ফিরে আসতে হবে বাস্তবের মাটিতে আর একটু একটু করে নিজের প্রচেষ্টায় গড়তে হবে নিজের জীবন। বর্ষার শুরু থেকেই যেমন বিন্দু বিন্দু জল জমে গঙ্গাকে কানায় কানায় ভরে তোলে, জীবনের শুরু থেকেই একটু একটু করে সুচিন্তিত অভ্যাস দিয়ে কানায় কানায় ভরতে হবে জীবন নিজের মত করে। তবেই বিদায়ের প্রাক্কালে স্মৃতি সুধায় ভরা থাকবে বিদায়ের পাত্র খানি । নিজের প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার অভাবে জীবন শেষ হতে পারে বিষাদের অশ্রুজলে, নীরবের মর্মতলে । কোন পথ আমরা গ্রহণ করব তা ঠিক করতে হবে ছাত্র বয়সেই । এক অরুণ প্রভাতে, করুন তপনে, নীরব নয়নে প্রতিজ্ঞা করতে হবে সূর্যের মত রিক্ততার বক্ষ ভেদ করে আপনাকে উন্মোচিত করবার। সে পথ কঠিন। সেই পথে কখনোবা চলতে হবে একাকী। তবুও সেই কাঙ্খিত পথে যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলাই চলতে হবে। যে পথে যেতে হবে সে পথে হয়তো তুমি একা, নয়নে আঁধার রবে তবুও তোমার পরশ সারা রাত নতুন তারা ফোটাবে অন্ধকার দূর করবে চিরতরে ।
ছোট ছোট নৌকা যেমন ফোলা পাল তুলে সূর্যের কিরণ নেয়, পাখিরা যেমন সুন্দর পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় উন্মুক্ত আকাশতলে, ছাত্র জীবনে গড়ে তোলা সুচরিত্র নিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রাণবন্ত ভাবে আচরণ করতে হবে। চলার পথে প্রতিটা মানুষের জীবনকে একটু রঙিন করতে হবে নিজ জীবনের স্পর্শে।বালুকাতটে আছড়ে পড়ে মহা সমুদ্রের শত বৎসরের তরঙ্গ হারায় তার প্রাণশক্তি, কালের নিয়মে মানুষও তেমন হারায় তার জীবন শক্তি । কিছু জীবন স্পর্শ করা, উন্নত করা জীবনের এক মহৎ উদ্দেশ্য। ইশ্বরের সেবায় নিবেদিত ফুল যেমন খুঁজে পায় তার জীবনের সার্থকতা, মানুষের সেবায় নিবেদিত জীবন ঠিক সেই ভাবেই সার্থকতা খুঁজে পায়। সর্বজনের মনের মাঝে মুক্তি পাক আমাদের জীবন । এক উদ্দেশ্য নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবনের উদ্দেশ্য। অনেক তিরস্কার নীরব হয়ে সহ্য করা যায়, কিন্তু জীবনের অন্তিম কালে, পক্ক কেশ আর শুষ্ক মুখে জীবন নিজের হাতে গড়তে না পারার আক্ষেপ সহ্য করা কঠিন। বস্তুকেন্দ্রিক জীবনের অনেক আনন্দই স্বল্প তেলের প্রদীপের মত ক্ষণস্থায়ী । নিজের নিষ্ঠাবলে নিজেকে উন্নয়নের পথে চিরকাল ধরে রাখার আনন্দ নক্ষত্রের আলোর মতোই দীর্ঘস্থায়ী ।
নিজস্ব কর্ম বা অপকর্ম একটু একটু করে আমাদের জীবনকে মাকড়সার জালের মত বেঁধে ফেলে। কিছু জীবন মুক্ত পাখির মত খোলা আকাশে উড়তে থাকে, কিছু বা বাঁধা পড়ে অলসতার বেড়াজালে বন্দি পাখির মত। অন্য মানুষের জীবন থেকে শিখতে হবে কিন্তু চিন্তাহীন ভাবে অন্যের জীবন দেখে সেই পথে পরিক্রমা করা ঠিক নয়। অন্য মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য না জেনে তার সুরে সুর মিলিয়ে বেলা কাটিয়ে জীবনকে সন্ধ্যা কালে উত্তীর্ণ করা অর্থহীন। বনের পাখি আর খাঁচার পাখি যেন একে অপরের জীবন দেখে হিংসা না করে। কারণ আমাদের পথ আমাদের নিজস্ব কর্ম বা অপকর্মের ফল। আমাদের অতীতের বেছে নেয়া অভ্যাস আমাদের বর্তমান জীবন পথের কারণ। যে অবস্থাতেই আমরা থাকি না কেনো, আমাদের আশা রাখতে হবে ভবিষ্যতকে উন্নততর করবার। আমাদের সুচিন্তিত কর্ম আমাদের অবস্থান উন্নত করতে সক্ষম। আমাদের পরিশ্রমই সেই নতুন পথের দরজা খুলে দেবে। কবির ভাষায়, "নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার" । কিছু মানুষকে প্রত্যক্ষ করি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জীবন পরিচালনা করতে। সহজ পথ, মিথ্যার পথ, নিষ্ঠার কার্পণ্য কোনো মহৎ কাজ সাধন করতে পারে না। ফু দিয়ে কখনো আকাশের তারা নেভানো যায় না। নিজের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়, নিরলস সাধনার মাধ্যমে যখন নিজেকে নক্ষত্রের মত আকাশের বুকে মেলে ধরা যায় তখন সেই নক্ষত্রের আলোকে নিন্দার ফু নিভিয়ে দিতে পারে না, বরং পৃথিবীর অন্ধকার দূর হয়। ছাত্র জীবনের উদ্দেশ্য নিজের জীবনকে সেই নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল করে মেলে ধরা সমাজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, মনব জাতির কল্যাণে।
জীবনটা লিফটে ওঠার মতো নয়, সিঁড়িতে চলার মতো। আমাদের চরিত্রকে উজ্জ্বল করার জন্য বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আমাদের নিজেকে পিষতে হবে, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। যখন আমরা আমাদের চরিত্রকে উজ্জ্বল করি তখন আমাদের খ্যাতি উজ্জ্বলতর হয়। তাই কঠিন পরিস্থিতি দেখে ভয় পাওয়া নয়, বরং কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া সাফল্যের পথে এক কাঙ্খিত পদক্ষেপ। "বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেনো করি ভয় "। ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর ফুলের মত সুন্দর করে জীবন প্রস্ফুটিত করবার। আমাদের বিকাশ পিতা মাতার গর্ব। মানুষের সেবায় নিবেদিত হওয়া সফল জীবনের গোপন রহস্য। "মুক্ত কর ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধর নিজেরে কর জয় " ।।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct