বই মেলায় যাবে
মোঃ আব্দুর রহমান
__________________
“আমি বললামতো আমার বয়স এগারো বছর মা!” ঠাস করে পরির তুলতুলে গালটাকে টুকটুকে লাল করে দিলো মমতাময়ী মা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর গালটা হাতাচ্ছে পরি! ওদিকে দরজায় বোয়াল মাছের মতো গোল্লু চোখে উঁকি দিয়ে দেখছে কাজের ছেলে ছক্কু। অবস্থা বেগতিক দেখে পা জড়িয়ে ধরলেন মেম সাহেবের। “আম্মাগো আফা মনিরে মাইরেননা! আমি বই মেলাতে যামুনা!আমার বাসাত কত্তো.. কাম।” অবশেষে ছক্কুর অনুনয়-বিনয়ে থামলেন পরীর মা। হ্যাঁ,বিষয়টি হলো আগামীকাল শুক্রবার। ছুটির দিনে বাবার সাথে অমর একুশে বই মেলাতে যাবে পরি।এটা বেশ আগেই ঢাকঢাক ঢোল বাজিয়ে না হলেও, কানকানে পাকাপাকি-ই করা ছিলো। কিন্তু সঙ্গে নিতে চান; বারো বছর বয়সি কাজের ছেলে ছক্কুকেও। কারণ ছক্কুর বই মেলার নানান বইয়ের রঙ, সেখানকার ঢঙ এবং নতুন বইয়ের গন্ধ শোকার খুব..ইচ্ছে। শখ আছে গ্রামের ডাহুক ডাকা দুপুর,আর শাপলা ফোটা পুকুরের কথা বই গুলিতে কিভাবে সাঁজানো হয়েছে সেটা দেখার। অনেক দিন... হলো গাঁয়ে যাওয়া হয়না। মা মারা যাবার পর,বাবা আর একটি বিয়ে করে! সৎ মা বাবাকে ফুলিয়ে- ফাঁপিয়ে-বুঝিয়ে টাকার লোভ দেখিয়ে,ওকে পরিদের বাসায় কাজ করতে পাঠায়। আগে ছক্কুও গাঁয়ের প্রাইমারীতে-ই পড়তো। সকালে মায়ের হাতে মুড়ি-পাটালি খেয়ে বিদ্যালয়ে যেতো। দুপুরে এসে সজনে শাকে দলা পাকানো মায়ের হাতে গরম ভাতের লোকমাও খেতো। আর ঝিঁ ঝি ডাকা রাতে পড়তো এবং মায়ের কাছে চাঁদ মামার গল্প শুনে,বুকে মাথা রেখে চাঁদের বুড়ীর দেশ দেখতো। সেই ছক্কুকে সঙ্গে নেয়ার কথা বলতেই, মা যখন বললো,” এইটুকু মেয়ের কতো বড় কথা!” তখন-ই এত্তো এত্তো লঙ্ককান্ড ঘটে গেলো!
রাতে পরীর গায়ে খুব জ্বর এলো! বমিও করেছে কয়েকবার! এমনকি এখনও পেটে পড়েনি কোন দানাপানি! পড়তেও বসেনি আজকে। ছক্কু আর স্থির হয়ে থাকতে পারলোনা। নিজেই ডেকে নিয়ে আসলেন এ-বাসার পারিবারিক ডাক্তার রাজন সাহেবকে। ডাক্তার এসে পরিকে দেখে ওষুধ দিয়ে গেলেন। আর বললেন,কিছু খাওয়ানোর পর ওষুধটা খাওয়াতে হবে। একটু পরে ছক্কু একটি সিরামিকের বাটিতে জাউ রান্না করে নিয়ে এলেন। মেম সাহেব অবাক হয়ে সব দৃশ্যগুলি দেখছেন!রুমে প্রবেশ করে কাজের ছেলের মতই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছক্কু। কারণ ও যে কাজের ছেলে,সেটা আজকের ঘটনার ডোজটা ওকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ করেই মেম সাহেব বললেন,”কিরে ছক্কু আয় কাছে আয়,দেখতো ওকে একটু খাওয়াতে পারিস কিনা।”কথাটা শুনে প্রথমে আকাশ থেকে পড়লেও,পরে বুঝতে পারলেন তিনি মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছেন। নরম সুরে...পরিকে ডেকে তুললো। ছক্কু চামচে তুলে একটু একটু করে ধোয়া উড়তে থাকা জাউ;পরির মুখে দিতে লাগলো। পরীর দু’চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে জাউয়ের বাটিতে। সেই জল রাশির জলীয় বাস্প ছক্কুর হৃদয়েও কান্নার মেঘ জমাচ্ছে। নিজের চোখে বৃষ্টি নামার আগেই, ঘারের গামছা দিয়ে মুছে দিলো পরির চোখের জল।
আর বলতে লাগলো, “আফামনি কান্দেনা, খান তাইলে ভালো হবেন। কালকে বই মেলাত গিয়া বই আনবেন। আর বাসায় আসলে আমারে পইরা শুনাইবেন। অসুবিধা কোথায়,কত্তো মজা হইবো। এদিকে আমি বাসায় থাইকা, আপনার জন্য রুই মাছের ঝোল করবো। আপনার ফেরার পর সবাই মজা করে খাবো।” ফাগুনের ভোরে কোকিল ডাকছে, পলাশ এবং শিমুল গাছ ঝাকাচ্ছে শালিক পাখি। জানালার পর্দাটা ফাঁকা করে দিলো বাসন্তী হাওয়া। আর ঝরে পড়া ফুলের দৃশ্য ধরা পড়লো পরীর চোখে; যেন সবুজ ঘাসে বিছানো আছে ফাল্গুনি গালিচা। বাহিরে গাছের নীচে সেখানে বসে গল্প করছেন তাঁর বাবা-মা। হয়তো কালকের ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করছেন বাবার কাছে। পাশেই ড্রাইভার গাড়ীটা ধুয়ে প্রস্তুত করছে বই মেলাতে যাওয়ার জন্য। নাশতা শেরে গাড়ীতে ওঠার সময় আচমকা মেম সাহেব বললেন,”একটু অপেক্ষা করো তোমরা;”
“কেন আবার কি হলো?” - বললেন পরির বাবা। মেম সাহেব বললেন,”ছক্কুও তোমাদের সঙ্গে বই মেলাতে যাবে; আর আজ দুপুরে রান্নাটা আমিই করবো। আরও একটি কথা, এখন থেকে ছক্কু শুধু এ-বাসার কাজের ছেলে-ই নয়, সে পরির ভাই।” আনন্দের তরঙ্গ উঠলো পরির মুখে! ছক্কুর মুখেও ভেসে উঠলো ফাল্গুনি হাসি! অবশেষে খুব মজা করে,এ-বাড়ীর ছেলে ছক্কুও গেলো ওদের সাথে....অমর একুশে বই মেলায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct