যুদ্ধের মাধ্যমে ‘মহৎ’ উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে উলুখাগড়ার প্রাণ যাওয়া স্বাভাবিক, জর্জ বুশ যাকে মিঠা হাসি হেসে বলেছিলেন ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। আর যুদ্ধ বাধানোর মতো যে ব্যবস্থা বিশ্বে বলবৎ, তারই ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ গরিবকে আরও গরিবিতে ঠেলে দেওয়া, অলিগার্কদের ফুলেফেঁপে ওঠা। তাই ইউক্রেন যুদ্ধের এক দিনের খরচে কত মানুষের সারা জীবনের পেটের চিন্তা দূর হবে, তার তুলনা টানা ‘অর্থই প্রথম’ এই বিশ্বে অর্থহীন। যুগের পর যুগের গরিব মারায় জারি থাকা বন্দোবস্তের গোড়ায় হাত না দিলে পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হবে না। যুদ্ধের সেই পরিণামের কথা স্মরণ করিয়ে আশঙ্কার কথা লিখেছেন হাসান ইমাম।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতে রোজ রাশিয়ার ট্যাঁক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি ডলার। আর প্রতি রাতে খালি পেটে ঘুমাতে যায় বিশ্বের ৮২ কোটি মানুষ (করোনা মহামারি হানা দেওয়ার আগে সংখ্যাটি ১৬ কোটির কম ছিল)। এ দুটি তথ্যের তুলনা তেল ও পানিকে একত্র করার শামিল মনে হতে পারে। কেননা, তেল ও পানি উভয়ই তরল হওয়া সত্ত্বেও যেমন একে অপরের সঙ্গে যেমন মেশে না, তেমনি রাজার খায়েশ পূরণ আর প্রজার পটল তোলা তো এক জিনিস নয়। তবে দুটি দুই ক্ষেত্রই আসলে মানুষ মারার ইন্তেজাম। প্রথমটিতে গুলিগোলা-বোমাবারুদে, তাড়াতাড়ি; দ্বিতীয়টিতে বঞ্চনায়, পরোক্ষে, ধীরে ধীরে। যুদ্ধের মাধ্যমে ‘মহৎ’ উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে উলুখাগড়ার প্রাণ যাওয়া স্বাভাবিক, জর্জ বুশ যাকে মিঠা হাসি হেসে বলেছিলেন ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’।
আর যুদ্ধ বাধানোর মতো যে ব্যবস্থা বিশ্বে বলবৎ, তারই ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ গরিবকে আরও গরিবিতে ঠেলে দেওয়া, অলিগার্কদের ফুলেফেঁপে ওঠা। তাই ইউক্রেন যুদ্ধের এক দিনের খরচে কত মানুষের সারা জীবনের পেটের চিন্তা দূর হবে, তার তুলনা টানা ‘অর্থই প্রথম’ এই বিশ্বে অর্থহীন। যুগের পর যুগের গরিব মারায় জারি থাকা বন্দোবস্তের গোড়ায় হাত না দিলে পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হবে না। আফগানিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ গাঁটের কড়ি ঠেলেছে, মাথাপিছু হিসাবে প্রত্যেক আফগান নাগরিকের পেছনে তা ৫০ হাজার ডলার ব্যয়ের সমান। আফগানিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় চার কোটি। দুই দশক স্থায়ী আফগান যুদ্ধে আড়াই হাজার সেনাসহ প্রাণ গেছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মার্কিন নাগরিকের। ৬৯ হাজার আফগান সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। বেঘোরে মরেছেন ৪৭ হাজার বেসামরিক আফগান নাগরিক। বিপক্ষ বাহিনীর প্রাণহানির সংখ্যা ৫১ হাজার।২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার ঢেলে এত মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র কী পেয়েছে? প্রশ্নটা যতটা সরল, উত্তর ততটাই ‘জটিল’। ইউক্রেন যুদ্ধেরও কারণ তাই এককথায় বিবৃত হওয়ার নয়, এর উদ্দেশ্যও বহুমুখী। কিন্তু সব যুদ্ধের ক্ষেত্রেই যেটা সত্য, সেটা হলো ‘মৃত্যু’। প্রথম মৃত্যু ঘটে সত্যের; দ্বিতীয়ত তাঁদের, যুদ্ধের সঙ্গে যাঁদের দূরদূরান্তের সম্পর্কও থাকে না—উলুখাগড়া, মানে সাধারণ মানুষ। এরপরও একটা কথা থাকে। মানবিক মর্যাদায় সব মানুষ সমান বলে যে ‘সত্য’ প্রচারিত, তা যুদ্ধের সময়, আগে বা পরে— সব সময়ই ‘মৃত’। কদিন আগেই ইউনিসেফ জানাল, ইয়েমেন সংঘর্ষের ৭ বছরে শুধু শিশু হতাহতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে সংস্থাটি বলছে, সহিংসতা, দুর্ভোগ ও বঞ্চনার এক ‘সাধারণ ক্ষেত্র’ হয়ে উঠেছে ইয়েমেন। এ অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করতে দরকার একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধান।
ফিলিস্তিনে হররোজ মানুষ মেরে ‘হাত মশকো’ করছে ইসরায়েলি বাহিনী। সিরিয়ায় রক্ত ঝরছে প্রতিদিন, এক যুগের বেশি সময় ধরে। কাশ্মীরেও প্রাণহানি নতুন কিছু নয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ‘কচুকাটা’ করার তথ্যও কারও অজানা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘মহৎ’ যুদ্ধ শেষে ইরাক, আফগানিস্তানে ‘শান্তি’ কতটা এসেছে, তা-ও তো প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে সবারই জানা। হতাহতের সংখ্যার বাইরে লাখ লাখ মানুষের জীবন আর ‘মানুষের জীবন’ নেই। ভিটেমাটি, অর্থকড়ি ফেলে শুধু প্রাণটুকু হাতে নিয়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে তারা একটু শরণ পাওয়ার আশায়। শরণার্থীশিবিরে তাদের বেঁচে থাকাকে আর যা-ই হোক, মানবিক বলা যায় না। ইউক্রেন থেকেও প্রতিদিন হাজারো মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। ইউরোপের এসব দেশ তাদের দিকে হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশের শরণার্থীদের জন্য ইউরোপের দরজা কতটা খোলা থাকে, এই সরল প্রশ্ন তোলা যায় বৈকি। কিন্তু এবারও উত্তর ততোধিকই ‘জটিল’। ইউক্রেনীয়দের জন্য পশ্চিমা শহরগুলোর রাজপথে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাগম পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যগুলোর একটি। যুদ্ধকে ‘না’ বলার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? একজনের দুঃখ আরেকজনকে ছোঁবে, মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়াবে—এমন বিশ্বই তো সবার আরাধ্য। কিন্তু দশকের পর দশক ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো বর্বর হামলার বিপক্ষে কোথাও কোনো ‘আহ্-উহ্’ও শোনা যায় না। সিরীয়দের দুর্দশার প্রতিকার দাবি করে একটা প্ল্যাকার্ডও উঁচিয়ে ধরেন না কেউ! ইরাকে ‘রক্তের নদী’ বয়ে গেল, কারও কিছু এসে-গেল না! বুলেটে মরাই যেন ফিলিস্তিনিদের নিয়তি। ৮০ কোটি মানুষ তো তিন বেলা না হোক, এক-আধবেলা খেতে পান। কিন্তু ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ রীতিমতো ‘অনাহারী’। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক হিসাবে ইলন মাস্কের অর্থকড়ির মাত্র ২ শতাংশ ব্যয়ে (মাত্র ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার) এই সোয়া চার কোটি মানুষ বেঁচে যেতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধে প্রতিদিন ঢালা হচ্ছে এই অর্থের চার গুণ। ৮০ কোটি মানুষের গরিবি ঘোচানো তাই এতটাই ‘সহজ’ যে তা কয়েকজন মানুষের ‘যান করে দিলাম’ বলার মতো। কিন্তু কাদের জন্য বলবেন তাঁরা? এই ‘কালা আদমি’রা তো আর পশ্চিমের কেউ নয়!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct