রাশিয়ার নিন্দা না করে ভারত নিছক গড়পড়তা মানের আনুষ্ঠানিক ভাষায় ‘সংঘাতে জড়িত সব পক্ষকে’ সংঘাত কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে। ভারতের এ আহ্বানের ভাষা এমন ছিল, যেন ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়ই সমান শক্তিমত্তা নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে রাশিয়ার আগবাড়িয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়েও ভারত আপত্তি তোলেনি। ইউব্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে লিখেছেন শশী থারুর। আজ প্রথম কিস্তি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ ভারতের কৌশলগত দুর্বলতাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। বিশ্বে ভারতের অবস্থান কী, দেশটির আঞ্চলিক নিরাপত্তা কেমন অবস্থায় আছে এবং বিশ্বের সঙ্গে দেশটির দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কবিষয়ক প্রজ্ঞা কতখানি—এসব মৌলিক প্রশ্ন এখন উঠে আসছে। ভারত রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ এবং মানবাধিকার পরিষদে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দাসূচক ভোটদানে বিরত ছিল। ভোটদানে বিরত থাকার প্রাথমিক ‘ব্যাখ্যায়’ দেশটি রাশিয়ার নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করেনি বা আকার-ইঙ্গিতেও রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা জানায়নি। রাশিয়ার নিন্দা না করে ভারত নিছক গড়পড়তা মানের আনুষ্ঠানিক ভাষায় ‘সংঘাতে জড়িত সব পক্ষকে’ সংঘাত কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে। ভারতের এ আহ্বানের ভাষা এমন ছিল, যেন ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়ই সমান শক্তিমত্তা নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে রাশিয়ার আগবাড়িয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়েও ভারত আপত্তি তোলেনি।
পরে এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতের দীর্ঘস্থায়ী নীতির পুনরাবৃত্তি করেছে। সেখানে ‘কূটনৈতিক আলোচনা ও সংলাপের পথে ফিরে আসার জন্য সব পক্ষ থেকে সমন্বিত প্রচেষ্টার’ আহ্বান জানানো হয়েছে। ইউক্রেনে যখন রাশিয়ার হামলায় নিরপরাধ মানুষ মরছে, এমনকি খারকিভে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভারতীয় ছাত্র যখন রাশিয়ার গোলায় নিহত হলেন, তখনো মোদির সরকার শান্তির জন্য অর্থহীন আপ্তবাক্য আওড়ে যাচ্ছে। একবারও রাশিয়ার সমালোচনা করছে না। রাশিয়ার সমালোচনায় ভারতের এ অনাগ্রহের কারণগুলো বোঝা খুবই সোজা। প্রথমত, ভারতকে তার অস্ত্র এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের প্রায় ৫০ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে রাশিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ঐতিহ্যগতভাবেই অনেক বেশি আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ। ক্রেমলিনের সঙ্গে সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আমল থেকেই ভারত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
রাষ্ট্রসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো বহুবার কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে রক্ষা করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তখন ভারতকে ক্রেমলিন সুরক্ষা দিয়েছিল। তাই চীনের সঙ্গে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা এবং ভূরাজনৈতিক সখ্য ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের চিন্তায় ফেলেছে। ক্রেমলিন চীনের ‘খদ্দের রাষ্ট্র’ পাকিস্তানকেও দৃশ্যত উষ্ণতা দিচ্ছে। রাশিয়া যেদিন ইউক্রেনে হামলা চালায়, সেদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মস্কোতে ছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। এটি একটি স্পষ্ট লক্ষণ যে উপমহাদেশে রাশিয়ার হিসাব-নিকাশ অনেকটাই বদলে গেছে। ভারত মনে করছে, রাশিয়ার আশীর্বাদের ছায়া পুরোপুরি হারানো এড়াতে মস্কোকে আঁকড়ে ধরা দরকার। তবে ভারতও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকেছে। মোদি সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তুলছে। সেই অংশীদারিতে ক্রমবর্ধমান উল্লেখযোগ্য প্রতিরক্ষা সম্পর্কও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। চীনকে রুখে দেওয়ার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ গ্রুপে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় নেতারা বুঝতে পারছেন, রাশিয়ার আক্রমণের বিরোধিতা করতে ভারতের ব্যর্থতা কোয়াড অংশীদারদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ককে বিপন্ন করে বসতে পারে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct