রাশিয়া ও ইউক্রেন এই দুই দেশের জনগণ কখনোই ভাবেনি তাদের মধ্যে এমন বৈরিতা হবে, শক্তিধর রাশিয়া তাদের বিপক্ষে অবস্থান নেবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির রাশিয়াবলয় থেকে বেরিয়ে ন্যাটোর দলভুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সখ্য এবং পশ্চিমাঘেঁষা নীতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বরদাশত করলেন না। মস্কোর ক্রেমলিন থেকে বার্তা দেওয়া হল। ইউক্রেনের এ নীতি গোটা অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত করবে। রাশিয়া তা কখনই মেনে নেবে না। কেননা ন্যাটো হচ্ছে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক শক্তির আধার। যুদ্ধের ভবিষ্যৎ ও পরিণাম নিয়ে লিখেছেন হাফসা সারোয়ার।
নব্বইয়ের দশকে ব্রেজনেভ শাসনের অবসান ঘটিয়ে খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্র হচ্ছে বর্তমান ইউক্রেন। তেল, গ্যাস, খনিজ এবং প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ শান্তিপ্রিয় জনগণের বাস দেশটিতে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ রুশ বংশোদ্ভূত। দুই দেশের জনগণ কখনোই ভাবেনি তাদের মধ্যে এমন বৈরিতা হবে, শক্তিধর রাশিয়া তাদের বিপক্ষে অবস্থান নেবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির রাশিয়াবলয় থেকে বেরিয়ে ন্যাটোর দলভুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সখ্য এবং পশ্চিমাঘেঁষা নীতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বরদাশত করলেন না। মস্কোর ক্রেমলিন থেকে বার্তা দেওয়া হলো। ইউক্রেনের এ নীতি গোটা অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত করবে। রাশিয়া তা কখনই মেনে নেবে না। কেননা ন্যাটো হচ্ছে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক শক্তির আধার। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন থেকে শুরু করে ইউরোপের প্রায় ৩২টি দেশ ন্যাটো দলভুক্ত। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে একযোগে সব দেশের সামরিক সহায়তা পাবে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া রাশিয়ার হস্তাগত হয়। পরে বেলারুশও রাশিয়ার আয়ত্তে চলে আসে। ক্রিমিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা তার পাশ দিয়েই কৃষ্ণসাগরের অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণসাগরে নৌবহর পাঠালে গোটা অঞ্চলকে নিজ আয়ত্তে নিতে চায়। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অনেক হিসাব কষেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তিনি ক্ষমতাসম্পন্ন একজন জনপ্রিয় শাসক হলেও অধিকাংশ রুশ জনগণ এ যুদ্ধ চায়নি। কথায় আছে, রাশিয়া যুদ্ধের চিন্তা করে পাঁচ বছর যুদ্ধ করে পাঁচ দিন আর আমেরিকা যুদ্ধের চিন্তা করে পাঁচ দিন যুদ্ধ করে পাঁচ বছর। যুদ্ধে আমেরিকা, ব্রিটেন, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইন্ধন জোগালেও যুদ্ধ শুরু হওয়ার তৃতীয় দিনেই তারা সাফ সাফ জানিয়েও দেয় যুদ্ধে তারা জড়াতে চায় না। এবং অন্তর্নিহিত কারণও রয়েছে—সুদীর্ঘ সময় মহামারি করোনার অবস্থান, অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মাত্র নিজেদের গোছাতে শুরু করেছে।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়, ইরাক ও সিরিয়া যুদ্ধে যত উদ্বাস্তু শরণার্থী ইউরোপীয় দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে, জনগণ ভাবছে এ বোঝা আমরা কেন বহন করব। তাই বাইডেন প্রশাসনও চাচ্ছে যুদ্ধটা এখন রাশিয়ার দিকেই ধাবিত হোক। এ যেন দুই পরাশক্তির খেলা। অপর শক্তিধর চীন রাশিয়ার সমর্থক হলেও নীরব পর্যবেক্ষণ করছে। রাশিয়ার বলয়ে থাকা ভারত নীরব রয়েছে। ইরান বলছে, ন্যাটোর উসকানিতেই যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হলো। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম অঙ্গরাজ্য যখন ছিল ইউক্রেন, তখন বেশ কয়েকটি পারমাণবিক বোমা ইউক্রেনের মালিকানায় চলে যায়। রাশিয়া এ বোমাগুলো দাবি করলে ইউক্রেন তার সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি চায়। ১৯৯৪ সালে আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও ইউক্রেনের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক ইউক্রেন নিজেকে পারমাণবিক বোমামুক্ত করে। এখন রাশিয়া সে চুক্তিও উপেক্ষা করল স্বার্থান্বেষী হয়ে। রুশ সেনাবাহিনীর হামলায় যুদ্ধের শুরুতেই তাদের হস্তগত হয়ে যায় ইউক্রেনের চারটি শহর। দেশটির গোটা অঞ্চলেই নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্দশা, সামরিক বিপর্যয়, হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ। রাজধানী কিয়েভে চলছে তুমুল লড়াই। দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর খারকিঙের কেন্দ্রস্থলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রয়েছে। কিয়েভ অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে কয়েক মাইল দীর্ঘ কয়েক শ সামরিক বহর। রুশ বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিয়েভের দখল নিয়ে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির দেওয়া ভাষণে স্পষ্ট বলেন—সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি দেশ ছাড়বেন না। ইউক্রেনীয় জনগণ দেশপ্রেমিক। জনগণের এক বিরাট অংশ স্বাধীনতা রক্ষার্থে তাদের জীবন দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধ অংশ না নিলেও ইতিমধ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে। ইতিমধ্যে লাখ লাখ শরণার্থী পোল্যান্ড, রোমানিয়াসহ কয়েকটি দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ায় অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। ইউরোপ রাশিয়ার ব্যাংকগুলো ফ্রিজ করা হয়েছে। তেলের বাজার টালমাটাল। তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গোটা বিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হুংকার দিয়েছেন—ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহার করা না হলে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অবস্থানে অনড়। তিনি যুদ্ধের মাধ্যমেই ইউক্রেনকে আয়ত্তে এনে তার অধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। জানান দিতে চান তাঁর শক্তি, সামর্থ্য ও ক্ষমতা। গোটা অঞ্চলের একচ্ছত্র মুরুব্বি হিসেবে সবাই যেন তাঁকে মান্য করে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইউক্রেন দখলের অভিলাষ সম্ভবত দীর্ঘসূত্রতায় যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের সার্বিক চাপ, সামরিক সহযোগীদের প্রতিহত করা গেলেও অর্থনৈতিক অবরোধ রাশিয়ার জন্য চিন্তার কারণ বটে। যুদ্ধের পরিণতি সময়ের ব্যাপার, তবে এটা স্পষ্ট—যুদ্ধ–পরবর্তী পৃথিবী দুই পরাশক্তিকে ছাপিয়ে ত্রিমাত্রিক ক্ষমতার দিকে ধাবিত হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct