আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থায় স্থানীয় প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, এবং পরিবেশগত বৈচিত্রের সৌন্দর্য কাছে থেকে অবলোকন ও প্রাকৃতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ইকো ট্যুরিজমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটন শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্র গুলির মধ্যে ইকো ট্যুরিজমের উন্নয়ন ও বিকাশ সর্বাপেক্ষা দ্রুততম। কোন একটি অঞ্চলের স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ও জীব বৈচিত্রকে পরিপূর্ণ সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে ইকো ট্যুরিজমের পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন সজল মজুমদার।
আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থায় স্থানীয় প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, এবং পরিবেশগত বৈচিত্রের সৌন্দর্য কাছে থেকে অবলোকন ও প্রাকৃতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ইকো ট্যুরিজমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটন শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্র গুলির মধ্যে ইকো ট্যুরিজমের উন্নয়ন ও বিকাশ সর্বাপেক্ষা দ্রুততম। ইকো ট্যুরিজম বাস্তুতান্ত্রিক পর্যটন নামেও পরিচিত। মূলত ভ্রমণের পাশাপাশি পর্যটকদের পরিবেশ সম্পর্কিত ব্যাপারে সুশিক্ষিত করা, বিভিন্ন স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃতি পাঠের সুবিধা, প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্রে ভরপুর স্থানগুলির উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ আর্থিক সাহায্য প্রদান, ইকো ট্যুরিজম কে কেন্দ্র করে স্থানীয় অধিবাসীদের আর্থিক সহযোগিতা এবং সক্ষমতা প্রদান, স্থানীয় সংস্কৃতি কে নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি বহুবিধ উদ্দেশ্য গুলি এর সাথে জড়িত। কোন একটি অঞ্চলের স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ও জীব বৈচিত্র কে পরিপূর্ণ সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে ইকো ট্যুরিজমের পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, ইকো ট্যুরিজমের স্থান গুলোকে ভোগ বিলাসের জন্য প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার না করে পরিবেশ বান্ধব ভাবে যাতে ব্যবহার করা হয়। পর্যটনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবও যাতে না পড়ে, তথাপি ইকো ট্যুরিজম পরিবেশগত অবনমনের কারণ হয়ে যাতে না দাঁড়ায় সেদিকেও নজর দেওয়া উচিত। প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে ভারতবর্ষে এমন বহু ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি, বোটানিক্যাল ও জুলজিক্যাল গার্ডেন, লেক, সাগর সংলগ্ন এলাকা, পর্বত ও তদসংলগ্ন জীব বৈচিত্র ভিত্তিক স্থান সমূহ রয়েছে যেগুলো ইদানিংকালে ইকো ট্যুরিজমের আদর্শ স্থান রূপে পরিগণিত হয়েছে। ঠিক একইভাবে পশ্চিমবঙ্গে ভারতের বৃহত্তম জীব বৈচিত্র কেন্দ্রিক অঞ্চল সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানগুলোতে ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এখানে প্রকৃতি বিশ্লেষণ কেন্দ্র এবং ইকো মিউজিয়ামও গড়ে উঠেছে। তবে ঠিক এর পাশাপাশি সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অংশে মানুষের দ্বারা ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়ে চলেছে। যদিও স্থানীয় এনজিও এবং বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংগঠনগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জায়গায় ম্যানগ্রোভ এর চারা রোপণ করে পুনরায় সেখানে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবার আপ্রাণ চেষ্টাও চলছে। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গ ইকো ট্যুরিজমের একেবারে আঁতুড়ঘর বলা চলে। উত্তরের সান্দাকফু থেকে ডুয়ার্সের চিরহরিৎ বৃক্ষের বনাঞ্চল, সিঙ্গালিলা, নেওরা ভ্যালী , গরুমারা জলদাপাড়া, চাপড়ামারি, বক্সা থেকে দার্জিলিং, কালিংপং, কার্শিয়াং ও সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা ইকো ট্যুরিজমের হটস্পট বলা চলে।
প্রসঙ্গত ব্যাবসায়িক দিকের পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজমে ফলে সংলগ্ন স্থানগুলোতে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কিনা, তার পরিবেশগত অভিঘাত মূল্যায়নও মাঝেসাজে সরকারি ও বেসরকারি স্তর থেকে করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে প্রান্তিক জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরও এগিয়ে রয়েছে। প্রান্তিক হলেও ইকো ট্যুরিজম শিল্পের বিকাশে উজ্জ্বল সম্ভাবনা এখানে যথেষ্ট রয়েছে। এখানকার ভালুকা, আঙ্গিনা, মহিপাল দিঘি, সারেং বাড়ী, কাল দীঘি, ধ ল দীঘি, মাতাশ,তপন দীঘি, মালিয়ান দীঘি, দো গাছি ও বালুরঘাট ফরেস্ট প্রভৃতি জায়গায় শীতকালে হরেক রকম পরিযায়ী পাখিরা সাময়িক আস্তানা গাড়ে। Asian open bill stock, Red collard dove, whistling duck, shikra, kinngfisher, Grey lag goose,Great cormorant, Indian Pitta এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে সম্প্রতিককালে বিভিন্ন দীঘি গুলোতে মাছ চাষ করার ফলে ইকো ট্যুরিজমের অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পরিযায়ী পাখির আনাগোনা দিন দিন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। পরিযায়ী পাখির নিশ্চিত গন্তব্য স্থল হিসেবে জেলার গুরুত্ব ক্রমশ কমছে।ইকো ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ‘ ইকোনমি ‘ বিষয়টি গভীরভাবে না দেখে স্থানীয় পরিবেশগত ভারসাম্য বিষয়টিই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেখা উচিত। পাশাপাশি দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রাচীন পলিমাটি অঞ্চলের অন্তর্গত হওয়ার ফলে এবং উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস এখানে অবস্থিত হওয়ার কারণে স্থিতিশীল কৃষির পদ্ধতি প্রয়োগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে এগ্রো টুরিজমের আদর্শ স্থান হিসেবেও ভাবা যেতে পারে। জেলার মৃতপ্রায় খাঁড়ি ও নদীগুলোর সংস্কার করার মাধ্যমে পুনর্যৌবন ঘটিয়ে আশে পাশের অঞ্চল কে ইকো ট্যুরিজমের অনুকূল ক্ষেত্র বানানো যেতেই পারে।তবে ইকো ট্যুরিজমই হোক বা স্থিতিশীল উন্নয়ন ই হোক অথবা পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষাই হোক, সবক্ষেত্রেই কিন্তু স্থানীয় জনগণকে সামাজিকভাবে সচেতন হওয়া জরুরী। নচেৎ বাসস্থান হারানো, পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিকূল অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে। তাই বাস্তুতান্ত্রিক পর্যটন কেন্দ্র কোথাও গড়ে তোলার আগে সেখানকার বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য পূর্বের ন্যায় একইরকম ভাবে স্থিতিশীল রাখার চিন্তাভাবনা করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতি প্রয়োজনীয়।
লেখক শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct