ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো একটি যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করে ব্যর্থ হয়েছেন। সে জন্য যুদ্ধ চলাকালীন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্যকে দায়ী করেছেন অনেকে। তবে এ কথা ঠিক পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেকে রাশিয়া ও তার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। পুতিন এ যুদ্ধের একটা শেষ দেখতে চান। এ নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ রফিক মাহাবিশ। আজ শেষ কিস্তি।
বছরের পর বছর ধরে বিশ্বসম্প্রদায় আমাদের প্রতি ভণ্ডামি করে আসছে। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর আমরা ফিলিস্তিনিরা নতুন করে আবার সেই ভণ্ডামির মুখোমুখি হলাম। আমরা জানতে পারলাম, আমরা আমাদের জন্মভূমিতে যেসব ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই, তা রুখে দেওয়ার মতো আন্তর্জাতিক আইন আছে। শুধু কাগজে-কলমের আইন নয়, সেটা কার্যকরও হয়। আমরা শিখলাম, যখন কেউ অন্য কোনো দেশে আগ্রাসন চালায়, তখন অন্য দেশগুলোর কিছু করার সামর্থ্য ও ইচ্ছা দুই-ই থাকে। আমরা শিখলাম, আগ্রাসনকারীর বিরুদ্ধে খুব দ্রুত নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও কার্যকর করা যায়। আমরা শিখলাম, মানুষ, যারা হতাহত হয় তারা শুধু সংখ্যা নয়, তারা জীবন্ত সত্তা। রাজনীতিবিদ, পণ্ডিত, বিশ্লেষক এবং আমাদের ভূখণ্ডে আগ্রাসনকারী ও আমাদের বাড়িঘর দখলদারিদের কাছ থেকে আমরা শিখলাম, দখলদারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ‘সন্ত্রাসবাদ’ নয়, সেটা ন্যায়সংগত অধিকার। গত কয়েক দিন সংবাদপত্র, ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভরে উঠছে ইউক্রেনের জনগণের ‘বীরত্ব ও প্রতিরোধ’-এর গল্পে। রাশিয়ার ট্যাংকবহরের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে কীভাবে সেনারা ব্রিজ উড়িয়ে দিচ্ছে, হাতের কাছে যা কিছু পাচ্ছে, তা-ই দিয়ে কীভাবে বেসামরিক নাগরিকেরা সশস্ত্র যানবাহনে হামলা চালাচ্ছে, সাধারণ মানুষ কীভাবে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং পরিখা খুঁড়ছে—এসব বীরত্বপূর্ণ কাহিনি আমরা জানতে পারছি। ইউক্রেনের বদলে ফিলিস্তিনের কোথাও যদি এমন একটি ঘটনা ঘটত, তাহলে সেটা আর বীরত্বের কাহিনি থাকত না। স্রেফ সেটাকে সন্ত্রাস বলে দায়ী করা হতো।
রাশিয়ার সৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য ইউক্রেনের মানুষ যে মলোটোভ বোমা বানাচ্ছে, সেটাও খুব ইতিবাচকভাবে তুলে ধরছে সংবাদমাধ্যম। ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা। তাদের সুরক্ষা দেয় ইসরায়েলের নিরাপত্তাবাহিনী। ফিলিস্তিনিরা যদি এ সময় দখলদারদের ঠেকাতে একই কাজ করে, তাহলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম কী ভূমিকা পালন করবে? ইউক্রেনের মানুষ রাশিয়ার দখলদারির বিরুদ্ধে এটা করলে বলা হবে হবে বীরত্ব। আর ফিলিস্তিনিরা সেটা করলে হবে সন্ত্রাস। এই বাস্তবতা শুধু ফিলিস্তিনের একার নয়। আমি নিশ্চিত যে আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, ইরাক, সোমালিয়া কিংবা কাশ্মীর—যেখানেই এ ধরনের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতার অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানকার জনগণেরও আমাদের মতো অনুভূতি হচ্ছে। গত সপ্তাহে আমি অনেকের কাছে শুনেছি, এখন ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, লিবিয়া কিংবা ইরাক নিয়ে কথা বলার সময় নয়। তাঁরা বলছেন, এখন ভিন্ন কোনো প্রশ্ন তোলা মানে রাশিয়ার হাত শক্তিশালী করা। তাঁদের উদ্দেশে আমি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে চায়, বিশ্বব্যাপী সামরিক আগ্রাসন, দখলদারি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার এখনই উপযুক্ত সময়। এখন পশ্চিমের সব শক্তিশালী রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং এমনকি ইসরায়েলের শাসকেরা প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন, আগ্রাসন ও দখলদারি খারাপ। প্রতিরোধের অধিকার শুধু বৈধ নয়, সম্মানজনকও। বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক না কেন, যুদ্ধের বলি সব মানুষকে সমর্থন দিতে হবে। আমাদের অবশ্যই ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান ও কাশ্মীরের বিষয়ে কথা বলা শুরু করতে হবে। ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতাসংগ্রামী সব মানুষের সংগ্রামকে সমর্থন করে যাবে। আমরা তাদের সঙ্গে সংহতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকি। কারণ, আমাদের সবার রয়েছে একই অভিজ্ঞতা। ইউক্রেনের জনগণের সংগ্রামে সমর্থন করে যাব, কেননা আগ্রাসনকারীরা তাদের জমি ও ভবিষ্যৎ চুরি করতে এসেছে। আমরা সেখানে আমাদেরও দেখতে পাচ্ছি।
(সমাপ্ত)
লেখক ফিলিস্তিনি লেখক ও সাংবাদিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct