পৃথিবীর প্রাণ মানব জাতি। আবার মানব জাতির প্রাণ তাদের মনুষ্যত্ব-মানবতা। মানুষের এই মনুষ্যত্ব ও মানবতার প্রকাশ ঘটে তার দৈনন্দিন আচরণে, সকল সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব পালনে, সকল মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ভালোবাসায়। কিন্তু সুদূর অতীত থেকে বর্তমান সর্বসময়ের রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র সমস্তু কিছু পর্যালোচনা করে শুধুই দেখা যায় দখলের লড়াই। শুধু সময়, স্থান, কাল, পাত্র আলাদা কিন্তু দখলের চিত্র-চরিত্র একই। লিখেছেন ফৈয়াজ আহমেদ....
সুদূর অতীত থেকে বর্তমান সর্বসময়ের রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র সমস্তু কিছু পর্যালোচনা করে শুধুই দেখা যায় দখলের লড়াই। শুধু সময়, স্থান, কাল, পাত্র আলাদা কিন্তু দখলের চিত্র-চরিত্র একই। সুদূর অতীতে গুহাবাসীদের জীবনেও ছিল সীমানা বা অঞ্চল দখলের জীবন-মরণ লড়াই। পরবর্তীকালে বা মধ্যযুগে ছিল সম্রাট-শাহানশাহ-রাজা-মহারাজাদের ওই সীমানা বা রাজ্য দখলের বীভৎস লড়াই। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। বর্তমান গণতন্ত্রের যুগেও অতীতের সেই একই দখল তরঙ্গ বহমান। সেই একই ধারা। নতুন বোতলে পুরনো পানীয়। মধ্যযুগের সমাজ জীবনের রাজনৈতিক ইতিহাসের ছবিগুলো যখন চোখে পড়ে, সে এক লোমহর্ষক ঘটনা, বীভৎস কাহিনী, যা লিখতে মন মাঝে মাঝে দুরূহ চিন্তা ও দুঃসহ চেতনায় প্রায় অবশ হয়ে পড়ে। যেখানে লক্ষ করি কত অন্যায়-অত্যাচার, কত অবিচার কত অমানবিকতা-পাশবিকতা, কত খুন-জখম। এত নৃশংসতা, এত নির্মমতা, এত নিষ্ঠুরতা কেন? মধ্যযুগে লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল রাজ্য দখল, দেশ দখল, সম্পদ দখল, তারপর নর-নারী দখল। যাদের দাস-দাসী রূপে ব্যবহার করা হতো। তাদের দুর্ভোগের কোনো সীমা থাকত না। তারা খোয়াড়ে গাদাগাদি করে থাকত। তারা মানুষ হলেও তাদের প্রতি অন্যান্য জীবের মতোই আচরণ করা হতো। জীবদেরও কিছু রেহাই ছিল। কিন্তু দাস-দাসীদের জীবনে সহমর্মিতা কারো মনে কখনো থাকতো না। অকালে যখন অকেজো হয়ে যেত, রাস্তার ধারে ফেলে দেওয়া হতো।
এ তো গেল দাস-দাসীদের কথা। রানী বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদেরও নিস্তার ছিল না। পরাজিত রাজা-উজির, সেনাপতি, আমির-উমরাগণের পরমা সুন্দরী স্ত্রী ও কন্যাদের দুর্দশাও একেবারে কম ছিল না। দখলদাররা তাঁদের নিয়ে কী যে দূর্বিষহ ব্যবহার করতেন, তা কেবল অনুমান করাই শ্রেয়। দেখা হতো, একই মাসে ওই সমস্ত রাজ পরিবারের রমণীদের তিন থেকে পাঁচ বার মালিক পরিবর্তন হতো, যেহেতু তাঁরা দখলদারের দখলীকৃত সম্পদ। মানবতার অপমৃত্যু ও অপমান এর থেকে বেশি আর কী হতে পারে! এখানে একটিই লক্ষ্য সকলের মধ্যে পরিলক্ষিত হতে দেখা যেত, কেবল ‘দখলদারী’। কে কতটা দখল করেছে করছে, ও করবে, এটাই ছিল মূলকথা। অতীত-মধ্য ও বর্তমান যুগেও সেই একই প্রথা বহমান। পশু-পাখি, জীব-জন্তুর জঙ্গুলে জীবনেও লক্ষ করা যায়, সেই একই দখলের লড়াই। কেউ কাউকে আপন এলাকা বা অঞ্চল ছাড়তে রাজি নয়। আবার আপন আপন অঞ্চলেও চলে দখলের পর ভোগের লড়াই। দিবারাত্রি অহরহ এ লড়াই চলছেই। জঙ্গলের এটাই যেন একমাত্র ধর্ম। যেহেতু তারা পশু ও জানোয়ার, তাদের কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তাদের বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান-গরিমা, চিন্তা-চেতনা নেই। তাই ওই দখলিপনায় তারা অপরাধী হয়েও নিরপরাধ আর বিদ্বান-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ মানুষের কথা, সে তো অমৃত সমান।
মানুষ নানা কারণে পরাধীন হতে পারে। কিন্তু বিনা কারণে প্রতিটি ‘মানুষের মন’টি স্বাধীন। এ কথা, মহামানব-মহাপুরুষরা বলে গেছেন। ওখানে কেউই লাগাম পরাতে পারে না। রাজা-বাদশাহকেও একজন অতিতুচ্ছ চাকর ঘৃণার চোখে দেখতেই পারে। তাই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, বনের পশু ও জানোয়ার ‘দখলে ও ভোগে’ মেতে আছে ঠিকই। কিন্তু সভ্য-শিক্ষিত-সুশিক্ষিত সচেতন সমাজ এবং জ্ঞান-গরিমার দাবিদার মানুষ কি ওই দখল ও ভোগের লড়াইয়ে এতটুকুও কম মেতে আছে? তাই যদি না হবে, তাহলে দেশের নব্বই শতাংশ সম্পদ মাত্র দশ শতাংশ মানুষ ভোগ করে কীভাবে? দেশের কিছু মানুষ মাসে পঞ্চাশ হাজার থেকে দু’লক্ষ টাকা মাইনে পাচ্ছে। যেখানে অগণিত হতভাগা মানুষ মাসে মাত্র তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা মাইনে পায়। এও কি দখল ও ভোগের চিত্র নয়? সব কিছুরই একটা সীমারেখা থাকা প্রয়োজন। আজ দেশে ‘দখল ও ভোগ’ সীমা অতিক্রম করেছে। তাই, সচেতন মানুষ আজ এই অসহনীয় ব্যবস্থার প্রতিবিধান এবং প্রতিকার চায়।
একবার এই হতভাগা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখুন, কী সকরুণ দৃশ্য। এই পৃথিবীর কত দুর্বল দেশ সবল দখলকারীর যাঁতাকলে পড়ে অসহায় জীব-জন্তুর ন্যায় আকাশ-ভাঙা আর্তনাদ করছে। তাদের যুগ-যুগান্তের শতাব্দীব্যাপী আর্তনাদ কি ওই সমস্ত দখলকারী দানবের কানে পৌঁছায় না? মানুষের মন যেমন মন্দপ্রবণ, তেমনি প্রশ্নপ্রবণও। মনে প্রশ্ন জাগে, একই জঙ্গলে বাঘ-সিংহ, নিরীহ হরিণ-জেব্রা ও বোকা বাইসন কেন? আবার একই পৃথিবীতে আমেরিকা-অবলুপ্ত প্রায় পানামা-বিধ্বস্ত ইরাক ও আড়ষ্ট ইরান, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান এবং হতদরিদ্র দেশগুলো কেন? সারা পৃথিবীতে এরূপ উপমার অভাব নেই। এ যেন কেবল ‘দখল ও ভোগের’ পরিশুদ্ধ উন্নতমানের সীমাহীন, হৃদয়হীন সর্বগ্রাসী সংগ্রাম। এটাই কি মানব সভ্যতার আধুনিক রূপ? আমাদের দেশ স্বাধীন হলো। বেনিয়ার জাত ইংরেজ আমাদের দেশকে প্রায় দুশো বছর ভোগ-দখলে রেখে মনের সুখে শাসন করল। তাদের সেই দখলদারি ছাড়াতে দেশের মানুষের কালঘাম ছুটে গেল। অগণিত প্রাণ, অকালে ঝরে পড়ল। কত সহস্র সন্তান পিতৃহারা হলো। কত নিষ্পাপ রমণী বিধবা হলো। কত মাতা ও পিতা সন্তানহারা হলো। কত শিশু অনাথ হলো। কাদের পাপে তারা প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করল, সে বিচার এক মহাবিচারক ছাড়া আর কেই বা করবেন। দেশবাসীই দেশকে একদিন পরাধীন করেছিল নইলে গুটিকতক ইংরেজের কিছু করার ছিল না।
সেই দেশ আবার স্বাধীন হলো । দেশ পরিচালনায় দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠল। এবার আবার সেই পুরনো পানীয় নতুন বোতলে এসে গেল। দখল ও ভোগের সংগ্রাম। কোন দল দেশের কতটা দখল করবে? কোন দল দেশের কত মানুষ দখলে রাখবে? এসবই যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্যব্রত হয়ে উঠল, যার জন্য আজও স্বাধীন দেশের কত নিরীহ-নিরপরাধ প্রাণ প্রত্যহ লুটিয়ে পড়ছে। দেশের শ্রীবৃদ্ধিও নেই, দেশের উন্নতিও নেই। কেবল আছে ‘দখল ও ভোগের’ কুৎসিত কামনা, লোলুপ বাসনা। এ পরিবর্তন শুধু পালা বদলের পালা মাত্র। দলগুলো একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ মাত্র। এই পরিবর্তন দেশেরও নয়, সমাজের নয়। দেশের জনসাধারণ সার্বিকভাবে সজাগ না-হওয়া পর্যন্ত এ ধারা চলতেই থাকবে। প্রতিটি দল এখন আপন আপন দলেও পোক্ত লেঠেল ও একান্ত অনুগত ‘দলদাস’ বানাতে ও বাড়াতে ভীষণ ব্যস্ত। জনগণ ঘুরে না দাঁড়ালে বার বার নির্বাচন হবে আর প্রমাণ হবে দেশটি গণতন্ত্রের অযোগ্য। যে সংগ্রামে ভালো কাজের জন্য আকাক্সক্ষা নেই, হৃদয়ের কোনো আকুতি নেই, মনের আকুলি-বিকুলি নেই তা পশুদের সংগ্রাম থেকেও কতই না নিকৃষ্ট মানের সংগ্রাম। যে সংগ্রাম কেবল ‘দখল ও ভোগে’র জন্য নির্বিচারে মানুষ খুন করতে ওস্তাদ দেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি যার এতটুকুও সহমর্মিতা বা সমবেদনা নেই, তা দূর অতীতে দানবের লড়াই ও পশুর সংগ্রাম ছাড়া আর কী? মানুষ তার দুঃসময় পারিবারিক জীবনে দু’মুটো অন্ন ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেতে বসেছে, সেই মানুষটিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে দিবালোকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা, এ কোন হিংস্রতা? এরই নাম কী দেশসেবা, দেশ গঠন? তা হলে গভীর জঙ্গলে থাকা জানোয়ারের কাজটি কী? মানুষে আর জানোয়ারে তফাৎটা কোথায়? মা ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে রাস্তায় ছেলে বা মেয়ের সামনে মাকে খুন করা বা ছেলে বা মেয়েকে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া, ছেলে বা মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ করা, মার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা, এটা কি ধরনের হিংস্রতা? এটাই কি সুস্থ সমাজের নিদর্শন?
মনে প্রশ্ন জাগে, সকল ধর্মই তো একই কথা বলে। স্রষ্টা সর্বশক্তিমান, সর্বস্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সর্বনিয়ন্তা- যাঁর আদি নেই, অন্ত নেই, দিন নেই, রাত নেই। তিনি একক সর্বনিয়ন্তা। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। মানুষের জ্ঞানের পরিধি তো খুবই কম। তাই আমরা কী ভাবব? নরকহীন এই পৃথিবীতে এই সব নারকীয় তান্ডবলীলা দিবারাত্রি দেখেশুনে আমরা হতবাক হয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক চিকিৎসক, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা যেভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আচরণ করেন তা দেখে শরীর শিউরে উঠে। কিছুটা বিদ্যা দখল করে ভোগে মত্ত, তাঁরা যেন হুঁশহারা ধাবমান প্রাণী। এখানে মানবকল্যাণ ও সেবা বিতরণের নাম-গন্ধও নেই। দেহের শক্তিতে দখল করে এবং মনের খুশিতে ভোগ করে। সেই দখল আর ভোগ। আমরা জানি, পৃথিবীর প্রাণ মানব জাতি। আবার মানব জাতির প্রাণ তাদের মনুষ্যত্ব-মানবতা। মানুষের এই মনুষ্যত্ব ও মানবতার প্রকাশ ঘটে তার দৈনন্দিন আচরণে, সকল সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব পালনে, সকল মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ভালোবাসায়। মানুষের প্রথম পরিচয় হোক, সে একজন মানুষ। সে পরিচয় জাতি-ধর্মে-বর্ণে নয়, শিক্ষা ও দীক্ষাতে নয়, টাকা-পয়সা পদ ও পদবীতে নয়, বংশ, গোত্র ও সমাজে নয়, কাল ও যুগে নয়, মানুষের পরিচয় হোক কেবল মানুষ বলেই। মানুষের জন্য মানুষের অকপট ভালবাসা, সহমর্মিতা, স্নেহ-শ্রদ্ধা, দয়া-মায়া-ক্ষমা প্রভৃতি থাক প্রতিটি মানুষের জন্য। সহমর্মিতাই পৃথিবীর প্রাণ। মানুষের প্রতি মানুষের লক্ষ্য হোক বিচ্ছেদ নয়, মিলন; বিষাদ নয়, বন্ধন; সংঘর্ষ নয়, সংহতি; ধ্বংস নয়, প্রগতি; হিংসা নয়, ভালোবাসা; হত্যা নয়, রক্ষা। মানুষ জানুক সারা পৃথিবীতে একটাই জাতি, তাহলো মানবজাতি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct