ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো একটি যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করে ব্যর্থ হয়েছেন। সে জন্য যুদ্ধ চলাকালীন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্যকে দায়ী করেছেন অনেকে। তবে এ কথা ঠিক পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেকে রাশিয়া ও তার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। পুতিন এ যুদ্ধের একটা শেষ দেখতে চান। এ নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ রফিক মাহাবিশ। আজ প্রথম কিস্তি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করল, তখন থেকেই বিশ্ববাসী ইউক্রেনের জনগণের বীরত্ব ও সহনশীলতাকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করছে। রাশিয়ার প্রথম সেনাদল ইউক্রেনের মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার ইউক্রেনবাসী হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। সামরিক শক্তির দিক থেকে অনেক বড় একটি বাহিনীর হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। ইউক্রেনের শহরগুলোতে যখন বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ চলছে, তাদের সামরিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকাগুলো যখন ধুলায় মিশে যাচ্ছে, তখনো সাহসী সেনা ও নাগরিকেরা লড়াই জারি রেখেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, ইউক্রেনবাসী শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাবে। ইউক্রেনের জনগণের এই বীরত্ব ও মর্যাদা বিশ্বের বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিককে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বাধ্য করেছে। ইউক্রেনের ‘প্রতিরোধ যোদ্ধা’দের প্রতি তাঁরা সমর্থন জানিয়েছেন। এই দলে আছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার লাপিডও। এক সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেনে রাশিয়ার এই হামলাকে তিনি ‘আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেন। এই হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি ইউক্রেনের নাগরিকদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ইসরায়েলকে বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সংঘাত নিরসনের পথ যুদ্ধ নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে যারা দূরে আছে, তাদের অনেকের কাছেই লাপিডের বক্তব্য কোনো তাৎপর্য বহন করে না। কিন্তু আমরা যারা ফিলিস্তিনবাসী ইসরায়েলের দখলদারি ও জাতিবিদ্বেষের শিকার, তাদের কাছে ইউক্রেনের জনগণের প্রতি লিপিডের এই সমর্থনসূচক বক্তব্য সজোরে চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছু নয়। নির্লজ্জ, ভণ্ডামির এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত এটি। রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানানোর ক্ষেত্রে শুধু ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভণ্ডামি করছেন না, ইসরায়েলের লোকজনও তা করছে। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর তাদের যে নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড, সেটা আড়ালে রেখেই তারা ইউক্রেনের জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামে সমর্থন দিচ্ছে। ইউক্রেনের সমর্থনে তেল-আবিবে হাজার হাজার ইসরায়েলি নাগরিক বিক্ষোভ করেছে। তারা ইউক্রেনের পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল করেছে। দাবি তুলেছে, ‘ইউক্রেনকে মুক্ত করো’। ফিলিস্তিনিরা বাক্রুদ্ধ চোখে সেটা দেখেছে। ‘ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো’, এমন দাবি নিয়ে কোনো ইসরায়েলিকে কোনো দিন রাস্তায় দেখা যায় না। তাদের জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের সম-অধিকারের কথাও তারা কোনো দিন বলে না। ফিলিস্তিনিরা যখন তাঁদের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামেন, ‘ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো’ বলে স্লোগান দেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশি বর্বরতা, এমনকি আরও খারাপ কিছুর মুখোমুখি হতে হয় তাদের। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ফিলিস্তিনিরা শুধু ইসরায়েলের কর্মকর্তা ও নাগরিকদের ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ দেখে নতুন করে কষ্ট পাচ্ছে না। বিশ্বসম্প্রদায়ের বড় একটা অংশের ভণ্ডামিও তাদের দেখতে হচ্ছে। ইউক্রেনের সীমানায় রাশিয়ার সেনাদের প্রবেশ এবং ইউক্রেন কখনো সত্যিকারের দেশ নয়, সেটা সব সময়ই রাশিয়ার অংশ, এমন দাবি করার পর সব পশ্চিমা নেতা, সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষকেরা এর বিরুদ্ধে অত্যন্ত আবেগপূর্ণ কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। দখলদারি কতটা অবৈধ, এর শিকার মানুষের সশস্ত্র সংগ্রামের কতটা অধিকার, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বায়ত্তশাসন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এসব যুক্তি তাঁরা অবতারণা করছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণ এবং তাদের কয়েক দশকের দীর্ঘ স্বাধীনতাসংগ্রামের সমর্থনে তাঁদের এসব যুক্তি ও ধারণা কখনোই দেখা যায় না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct