১৮৭১ সালে হাওড়া ব্রিজের সহিত কলকাতার ব্রিটিশ ডায়েরি
বেবি চক্রবর্তী
____________________
ইংরেজ বণিকরা প্রথমে জলপথের মাধ্যমে বানিজ্য করতে এসে এদেশের ধন, ঐশ্বর্য , প্রাচুর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে তৎকালীন ভারতীয়দের সরলতা ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে পুরো দেশটাকে,পাশাপাশি ব্যাবসা - বানিজ্যে’র সাথে সাথে এদেশের উন্নতি’র কথা ভাবে ইস্ট্ ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরে এখানেই তাঁরা আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ১৮৫৫-১৮৫৬ সালে হুগলি নদীর দুই তীরের পাড় বরাবর গড়ে উঠেছিল নতুন নতুন কলকারখানা। ব্যবসা’র সুবিধার জন্য কলকাতা থেকে হাওড়ায় যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সাহেব’রা একটা সেতু নির্মাণের কথা ঠিক করে। সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা যাচাই করার জন্য ইংরেজ চিফ্ ইজ্ঞিনিয়ার জজ্ টানবুল কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ২৯ শে মার্চ রিপোর্ট পেশ করলেও সেই সময় ব্রিজটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। ঠিক হয় যে সেতু নির্মাণের সবরকম দায়িত্ব সরাসরি সরকারের হাতে থাকবে না। তাই তৈরী করা হয় একটি “ট্রাস্ট্” ( কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট্ )। এই ট্রাস্টের অধীনে ১৮৭০ সালে ব্রিজ তৈরী’র পরিকল্পনা ঠিক হয়।১৮৭১ সালে তৈরী হয় কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট। এর অধীনে তৈরী হয় প্রথম হুগলি নদীর ওপর ভাসমান পুঁটন ব্রিজ। ১৫৪৮ ফুট লম্বা এবং প্রায় ৬২ ফুট চওড়া ছিল এই ব্রিজটি। জাহাজ বা স্টীমার চলাচলে’র জন্য সেতুটি মাঝখানে ২০০ ফুট খুলে দেওয়া যেত।
বিখ্যাত ইজ্ঞিনিয়ার স্যার গ্যাড ফোর্ড লেসলি এই হাওড়া ব্রিজের নকশা তৈরী করেন। তৎকালীন রেল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা প্রায় ২২ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরী করেছিলেন পুঁটন ব্রিজ। ১৮৭৪ সালে এই ব্রিজ তৈরীর কাজ শেষ হয়। কিন্তু সেই বছরই ভয়াবহ ঝড়ে বেশ অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া এই ভাসমান ব্রিজের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় জাহাজ ও স্টীমার যাতায়াতের ব্যবস্থা। জাহাজ ও স্টীমার গেলে এই পুঁটন ব্রিজ মাঝখান থেকে খুলে দেওয়া হত। ফলে সৃষ্টি হতে লাগল প্রচন্ড যানজটের।১৯০৬ সালে পরে রাতের বেলায় সেতু খুলে দেওয়ার কথা ঠিক হয়। এই বছরই ইস্ট্ ইন্ডিয়ান রেলওয়ের চিফ্ ইজ্ঞিনিয়ার আর এস. হায়ের্ড, ইজ্ঞিনিয়ার জনস্ স্কট্ ও কলকাতা করপোরেশনের চিফ্ ইজ্ঞিনিয়ার উবলু বি মেকেবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। কলকাতা থেকে হাওড়ার যোগাযোগের মাধ্যম ও সুবিধার কথা মাথায় রেখে প্রথমে এই কমিটি নদীর ওপর ভাসমান সেতুর বদলে একটি ক্যান্টিলিভার্ ব্রিজ তৈরীর সিদ্ধান্ত করে। হাওড়া সেতুর মূল সূচনা এখান থেকে শুরু হয়। যদিও বাধা - বিপত্তি কম ছিল না। সে সময় গোটা বিশ্বে ক্যান্টিলিভার্ ব্রিজের সংখ্যা ছিল মাত্র তিনটি। যার মধ্যে ক্যান্টিলিভার্ প্রযুক্তিতে কানাডায় “ দ্য কেবেজ্ সেতু “ ভেঙে পড়ার ঘটনায় লেসলি সাহেব সহ অনেক ইঞ্জিনিয়ারদের ক্যান্টিলিভার্ সেতু তৈরিতে মত ছিল না। তাছাড়া বন্দরের কাছে সেতুতে গাড়ি চলাচলের থেকে জাহাজ চলাচল ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্যান্টিলিভার্ সেতু থেকে ভাসমান সেতুর পাল্লা ভারী ছিল ফলে হাওড়া ব্রিজ তৈরী সেইসময় থমকে যায়। ইতিমধ্যেই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ এসে পড়ে। এই যুদ্ধের কবলে পরে এদেশের আমদানি কম হতে থাকায় আর্থনিতির ওপর চাপ আসে, ফলে নতুন করে কোন কাজ শুরু করার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন রাজি ছিল না। এর বেশ কয়েক বছর পর আবার হাওড়া ব্রিজ তৈরীর কথা উঠতে থাকে। ব্রিটিশ প্রশাসন তখন ইস্ট্ মার্টিন এন্ড কোম্পানির মালিক ১৮৩৩ সালে রাজেন্দ্র নাথ মুখার্জিকে সঙ্গে নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন। কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তখন কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান ক্লিমেন্ট হিন্ডলে, চিফ্ ইজ্ঞিনিয়ার জে. মাগ্লাসন্ , বিশিষ্ট ইজ্ঞিনিয়ার বেসিল্ মট্ স্যার বেসলিই প্রথম সিঙ্গেলস্ প্যান আটস্ ব্রিজ তৈরীর কথা বলেন। ১৯২২ সালে আর অ্যান্ড প্রস্তাব করেন ফলে কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ হয় যাতে মূলত ক্যান্টিলিভার্ তৈরির সুপারিশ করা হয়। ঠিক হয় যে এমন সেতু প্রযুক্তির সেতু তৈরি করা হবে যাতে নীচ দিয়ে অনায়াসে জাহাজ ও স্টীমার যাতায়াত করতে পারবে। ১৯২৬ সালে দি নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট পাশ হয়। ১৯৩০ সালে ১৫ ই মার্চ ব্রিটিশ সরকার হাওড়া ব্রিজ তৈরীর জন্য অগ্রসর হওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। সেইমত ১৯৩৬ সালে ৭০৫ মিটার দীর্ঘ হাওড়া ব্রিজ তৈরীর কাজ তৈরী হয়। সেই সময় বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম ক্যান্টিলিভার্ ছিল হাওড়া ব্রিজ। এই ক্যান্টিলিভার্ এর নকশা তৈরী করেছিলেন রেন্ডেল, পামার ও ট্রিটন। সে সব কন্ট্রাক্টশন কম্পানির তত্ত্বাবধানে প্রায় ২৫ মিলিয়ান অর্থ বিনিয়োগে ২৬,৫০০ টন স্টিল এই সেতু তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। যার মধ্যে ২৩ হাজার টন হাইড্রেসাইড্ টেস্টন্ স্টিল্ ছিল টাটা স্টিলের। কোন নাট বল্টু’র ছাড়া রিভেটিং এর মাধ্যমে তৈরী হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে বর্তমানে প্রায় ৩ লক্ষ থেকে সাড়ে চার লক্ষ পথ যাত্রীর যাতায়াত মাধ্যম। ১৯৬৫ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নামে হাওড়া ব্রিজের নামকরণ হয় ‘রবীন্দ্র সেতু’। দ্য গ্রেট ওয়ে টু কলকাতা হিসাবে পরিচিত হাওড়া ব্রিজ ১৯৪৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। যার প্রথম যান ছিল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী “ট্রাম “। দেশ - বিদেশে হাওড়া ব্রিজের জনপ্রিয়তা এমন যে কলকাতার হাওড়া ব্রিজ দর্শন না করে কেউ যায় না। বর্তমানে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট এর তত্ত্বাবধানে থাকা এই রবীন্দ্র সেতু যুগ যুগ ধরে অসংখ্য মানুষের যাত্রার সাক্ষী হয়ে আছে। হাওড়া ব্রিজ হল ব্রিটিশদের তৈরী একটি নিদর্শন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় ‘রবীন্দ্র সেতু’। তৎকালীন কলকাতা থেকে হুগলির যোগাযোগ মাধ্যম ছিল এই হাওড়া ব্রিজ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct