ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো একটি যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করে ব্যর্থ হয়েছেন। সে জন্য যুদ্ধ চলাকালীন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্যকে দায়ী করেছেন অনেকে। তবে এ কথা ঠিক পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেকে রাশিয়া ও তার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। পুতিন এ যুদ্ধের একটা শেষ দেখতে চান। এ নিয়ে লিখেছেন গাজীউল হাসান খান। আজ শেষ কিস্তি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর শাসনকালে একসময় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ন্যাটোর অন্য সদস্যরা তাদের প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করে না। সে ক্ষেত্রে আটলান্টিকের অন্য পার থেকে যুক্তরাষ্ট্র কেন একতরফাভাবে তাদের নিরাপত্তার জন্য অর্থ ব্যয় করে যাবে? ইউরোপকে তার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসেন ভোলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে তাঁর ভোটারদের কাছে অনেকটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সে বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। কারণ ট্রাম্পের সঙ্গে ছিল রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক রহস্যাবৃত সখ্য কিংবা সমঝোতা। সুতরাং ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল কিংবা ইউক্রেনের ইইউ ও ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে পুতিনের বিরোধিতা নিয়ে বিশেষ কোনো কথাই বলেননি ট্রাম্প। পুতিনের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায়ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রবীণ সিনেটর জো বাইডেন। ক্ষমতায় এসেই বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত সাম্রাজ্যবাদী কৌশল ও কর্মসূচিকে অগ্রসর করার প্রয়াস পান। পুরনো শত্রু রাশিয়া ও বিশেষ করে তার মিত্র গণচীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সমৃদ্ধিতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন বাইডেন। সে কারণে তিনি বিশ্ববাণিজ্য ও সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল এই দুই ক্ষেত্রেই চীন-রাশিয়ার উত্থান ঠেকানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক নম্বর অবস্থান’ ধরে রাখা। সেই সুযোগে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান কিংবা ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য যথারীতি তৎপর হয়ে ওঠেন ইউক্রেনের জনপ্রিয় অভিনেতা কাম নব্য রাজনীতিক জেলেনস্কি। তিনি ভুলে যান তাঁর সাবেক প্রেসিডেন্ট পেট্রো পরোসেনকোর পরিণামের কথা। পরোসেনকোও চেয়েছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে যোগ দিতে। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের অদৃশ্য দাবার ঘুঁটির চালে তিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হারান। এ কথাটি অনেকটাই ভুলে গিয়েছিলেন জেলেনস্কি।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান ভোলোদিমির জেলেনস্কির বর্তমান চলমান পরিস্থিতিতে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটি বুঝতে হলে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট সোভিয়েত রিপাবলিক (ইউএসএসআর) ভেঙে ১৫টি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর কেউই আর সমাজতান্ত্রিক নীতি কিংবা আদর্শে পরিচালিত হয়নি। সেই পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রাইকা’র সময়। অনেকের মতে, মূলত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্ররোচনায়। তবে সে যা-ই হোক, পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি দেখাশোনার জন্য উল্লিখিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো নিয়ে ‘কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটস’ (সিআইএস) নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছিল। সেই সংস্থার নেতৃত্বে ছিল রুশ ফেডারেশন। কিন্তু সেই সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কাজাখস্তানসহ বেশ কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নব্য এশীয় রাষ্ট্র ছাড়া ইউরোপীয় অংশের বিশেষ কেউ সেই সংস্থায় কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেননি। ইউরোপীয় অংশের অনেকেই তখন ক্রমে ক্রমে পশ্চিমা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে শুরু করেন অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। ইউক্রেনকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে না ঢুকতে দেওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর পুতিন। রাশিয়ার হাতে এখন বিভিন্ন ধরনের ছয় হাজার ৮০০টির বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৭০০টি বেশি। তবু গত বছর জেনেভায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক যৌথ সভায় তিনি একমত হয়েছেন যে পারমাণবিক যুদ্ধে কেউ জয়ী হয় না। সে কারণে পুতিন বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে চান। তার পাশাপাশি রাশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ কোথায় নিয়ে যাবে তাঁকে? এরই মধ্যে পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ইউক্রেন আক্রমণ এবং তাতে এ পর্যন্ত যে সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, তাকে কি গণহত্যা বলা যায়? এ ছাড়া রুশ বোমা ও আর্টিলারি গোলায় যেসব স্থাপনা ধ্বংস কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার জন্য রাশিয়ার কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে অনেক রুশ সেনা নিহত এবং এমনকি কয়েকটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং সেই যুদ্ধ কি একেবারেই একতরফা ছিল? সেসব নিয়ে চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হবে। তবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো একটি যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করে ব্যর্থ হয়েছেন। সে জন্য যুদ্ধ চলাকালীন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্যকে দায়ী করেছেন অনেকে। এ কথা ঠিক যে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেকে রাশিয়া ও তার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। পুতিন এ যুদ্ধের একটা শেষ দেখতে চান। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct