ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো একটি যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করে ব্যর্থ হয়েছেন। সে জন্য যুদ্ধ চলাকালীন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্যকে দায়ী করেছেন অনেকে। তবে এ কথা ঠিক পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেকে রাশিয়া ও তার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। পুতিন এ যুদ্ধের একটা শেষ দেখতে চান। এ নিয়ে লিখেছেন গাজীউল হাসান খান। আজ প্রথম কিস্তি
কৃষ্ণ সাগরের তীরে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ওভেসা ও মারিওপোলের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার পাশাপাশি রাজধানী কিয়েভ দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রাশিয়া। কিন্তু ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় (অর্থডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটি) কারণে কিয়েভ দখলে যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা যায়, সেদিকেই রাশিয়ার লক্ষ্য। হাজার বছরের পুরনো নগরী কিয়েভ একসময় ছিল রুশ সাম্রাজ্যের অখণ্ডিত রাজধানী। সে কারণেই ঐতিহাসিকরা বলেছেন, ‘কিয়েভান রুশ’। ১১৬৯ সালে বহিঃশত্রুর আক্রমণে কিয়েভ পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হলে রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছিল ভ্লাদিমিরে। এর আগে ১০ থেকে ১২ শতাব্দী ছিল কিয়েভের স্বর্ণযুগ (পূর্ব স্লাভিক সভ্যতা)। দীর্ঘ যুগের সেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি রুশ কিংবা ইউক্রেনের অনেকে এখনো ভুলতে পারেনি। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম হলে ক্রমে ক্রমে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দেখা দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিরোধিতা। ইউক্রেন স্বাধীন হলেও রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন এখনো মনে করেন, এ দুটি দেশের পারস্পরিক স্বার্থ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নগুলো এক ও অভিন্ন। ধারাবাহিক পশ্চিমা কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্রের কাছে তা যেন বিপন্ন না হয়।
এ অবস্থায় ইউক্রেনে রুশ সেনার ধীর ও সমস্যাসংকুল অথচ পরিকল্পিত আক্রমণের মুখে পশ্চিমা শক্তি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কিকে কিয়েভ থেকে পোল্যান্ড সীমান্তের কোথাও সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে। তাদের উদ্দেশ্য ইউক্রেনের বিভিন্ন অংশে বিপর্যয়ের পর জেলেনস্কির নেতৃত্বে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করে চলমান প্রতিরোধ সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত একটি দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশগুলো বিশাল অঙ্কের অর্থছাড়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রচলিত সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে ইউক্রেনকে যুদ্ধবিমান দেওয়ারও পরিকল্পনা করেছে তারা। ন্যাটোভুক্ত পোল্যান্ড থেকে তা সরবরাহ করা হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর মধ্যে ইউক্রেনের বিমানঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়েছে রাশিয়া। সে ক্ষেত্রে কোথা থেকে বিমান হামলা পরিচালনা করবে ইউক্রেন? পোল্যান্ড কিংবা অন্য কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে বিমান হামলা চালানো হলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এ ছাড়া তখন সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধ বলে বিবেচিত হবে। তাতে রাশিয়া সমগ্র ইউক্রেনের ওপর দখল প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাবে, যা বর্তমান সমস্যাকে আরো জটিল ও দীর্ঘায়িত করবে বলে সমরকুশলীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে তুরস্কের আনতালিয়াতে (তুর্কি) রুশ ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বসার কথা রয়েছে। তাতে উদ্ভূত পরিস্থিতির জট কতটা খুলবে বলা মুশকিল। তবে আলোচনার পথ খোলা থাকলে এ সমস্যা সমাধানেরও একটা পথ বেরিয়ে আসতে পারে বলে অনেকের ধারণা। রাশিয়া তার সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে গিয়ে ক্রমাগতভাবে ইউক্রেনের জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছে চরম পাষণ্ডতায়। ছিন্নমূল হয়ে পড়েছে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ। রসদ ফুরিয়ে আসছে। অন্যদিকে সমরাস্ত্রের অভাব ও যোগাযোগব্যবস্থার সংকটে ইউক্রেনের সেনা ও স্বেচ্ছাসেবীরা ক্রমেই বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে বলে জানা গেছে।
‘রাশিয়া না থাকলে বাকি পৃথিবী থেকেই বা আমার লাভ কী?’ সম্প্রতি এ কথা বলেছেন রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি অত্যন্ত বিষাদের সুরে আরো বলেছেন, ভাষা-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন কারণে একদিন রাশিয়া ও ইউক্রেনকে মানুষ একটি বৃহত্তর দেশ বলে মনে করত। ইউক্রেনকে ভাবত রাশিয়ার ছোট ভাই। এখন সেই ইউক্রেনের শাসক জেলেনস্কি রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্য ‘পশ্চিমা অপশক্তির’ সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। কৃষ্ণ সাগরের উত্তর তীরে অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপে ডেকে আনছেন ন্যাটো বাহিনীকে। সেই অবস্থায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তম রাষ্ট্র রাশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা কিংবা শান্তি ও স্বস্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? ন্যাটো বাহিনীর বর্তমান অবস্থান থেকে আরো পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ রাশিয়ার নিরাপত্তা কিংবা অস্তিত্বের জন্য এক বিরাট হুমকি। যুক্তরাষ্ট্র নব্বইয়ের দশকজুড়ে বিভিন্ন সময় বলে এসেছে ন্যাটো আর পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে না। এর পর থেকে ন্যাটোকে পাঁচবার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পূর্ব দিকে অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর আরো বিস্তৃতি রাশিয়ার কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়—বলেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। সে ক্ষেত্রে কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী একটি নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইউক্রেন কিভাবে আগ বাড়িয়ে তাদের ডেকে আনছে? এ প্রশ্নও রুশ প্রেসিডেন্টের। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক কারণেই রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কিংবা ন্যাটোতে সাবেক সোভিয়েত দেশ ইউক্রেনের যোগদানের বিষয়টি গোড়া থেকেই বিরোধিতা করে এসেছে। তাঁর মতে, ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরের তীরে কিংবা পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর একটি বিশাল সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হবে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি চলমান শীতল যুদ্ধকে আরো উসকে দেওয়ার সাম্রাজ্যবাদী অপকৌশল বলে বর্ণনা করেছেন পুতিন। সমালোচকরা বলেন, পুতিন যতটা সমাজতন্ত্রী, তার চেয়ে অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী। সেই ভাবাবেগ থেকেই তিনি প্রতিবেশী ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন, যা অন্তত মানবতার দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। পশ্চিমাদের বিবেচনায় সেটা যুদ্ধাপরাধ। (ক্রমশ...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct