প্রতি বছর ৮ই মার্চ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের প্রতি বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকারের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম ধ্বনি ওঠে ১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্ক সিটিতে। ১৯১০ সালে জার্মান সমাজকর্মী ক্লারা জেটকিন সর্ব প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব দেন, ১৯১১ সালে অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। রাষ্ট্রসংঘ ১৯৭৫ সালে প্রথম ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ ঘোষণা করে। এ নিয়ে লিখেছেন মো. শহিদুল ইসলাম। আজ শেষ কিস্তি।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও মহিলাদের অংশগ্রহণ খুব একটা সন্তোষজনক নয়। সম্প্রতি পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি সমীক্ষা (PLFS) ২০১৮-১৯ এটাই প্রতিফলিত করে যে, পশ্চিমবঙ্গের মহিলা শ্রমশক্তির হার ১৭.৫ শতাংশ যা ভারতবর্ষের গড় মহিলা শ্রমশক্তির (১৮.৬শতাংশ) তুলনায় অনেক কম। গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৬০ শতাংশ মহিলা আত্মকর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত আছে। বিপুল সংখ্যক মহিলাই ক্ষেতমজুর এবং বিড়ি শিল্পের কর্মসংস্থানের সঙ্গেও জুড়ে আছেন। অনেক গবেষণা পত্রের মাধ্যমে উঠে এসেছে যে, মহিলা বিড়ি শ্রমিকের স্বাস্থ্যের উপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং শ্রমের তুলনায় মজুরী কম পান।ভারতের বৃহত্তম দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পেও; MGNREGA, ২০১৮-১৯ এ আমাদের রাজ্যে মহিলাদের অংশ গ্রহন অনেক কম ৪৮.১ শতাংশ যেখানে আমাদের দেশের গড় মহিলা অংশ গ্রহন ৫৪.২ শতাংশ।
উপরোল্লিখিত নারী জাতির উন্নতির (সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক) পরিপ্রেক্ষিতে এই সীমিত তথ্যের ভিত্তিতে যে কোন সুস্থ মস্ত্রিস্কের মানুষ খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারে যে স্বাধীনতার ৭৫বছর পরও নারী উন্নয়ন এবং নারীর মর্যাদার বিকাশ কত দূর এগিয়েছে। এমতাবস্থায় মহিলারা কতটা তাঁদের অধিকারের বিষয়ে বঞ্চিত সেটা নিয়ে বেশি পর্যালোচনা না করায় বাহুল্য। সম্প্রতি আমাদের রাজ্য সরকার; দিদির অনুপ্রেরনায় অনেক নতুন নতুন মহিলা উন্নয়ন মূলক প্রকল্প চালু হয়েছে যেমন স্বনির্ভর গোষ্ঠী, লক্ষ্মীভান্ডার , রূপশ্রী , বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত কন্যাশ্রী ইত্যাদি- এইগুলো খুবই প্রশংসনীয়।এতসব প্রচেষ্টা, প্রণোদনা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর মর্যাদা কোথায় ? এই প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনেক আগেই আমদের চোখে আঙুল দিয়ে হারিয়ে যাওয়া নারী (মিসিং ওমেন) এই তত্ত্বটি দেখিয়েছেন। হারিয়ে যাওয়া নারী বলতে বোঝায় কোনো অঞ্চল বা দেশে প্রত্যাশিত নারীর সংখ্যার তুলনায় নারীর সংখ্যার ঘাটতিকে। নিখোঁজ মহিলাদের পরিসংখ্যানে ভারত ও চিন একটি বিশাল সংখ্যা অবদান রাখে। মহিলা নিখোঁজ হওয়ার অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে লিঙ্গ-নির্বাচিত গর্ভপাত, কন্যা শিশু হত্যা এবং কন্যা শিশুদের জন্য অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি উল্লেখযোগ্য। বাহ্যিক ভাবে মহিলাদের যে অবস্থা সেটা আমরা খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারি কিন্তু রবি ঠাকুরের ভাষায় অন্তপুরিতে অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে মহিলাদের সাথে কি ঘটছে তা আমরা খুব কমই বুঝতে পারি । এই মর্মে অর্থনীতিবিদ দেবরাজ রায়ের ‘লাইফ বোট এথিকস’ তত্ত্বটি খুবই প্রযোজ্য। এর মানে একটি ভয়ানক পরিস্থিতি যেখানে কাউকে বাঁচাতে অন্যজনকে প্রান দিতে হয়। অন্যজন বলতে এখানে আর কেও নয় পরিবারের একমাত্র মহিলা যারা পরিবারের মধ্যে সর্ব প্রথম ওঠে এবং সবশেষে ঘুমোতে যান; এটা সেই মহিলা যারা অক্লান্তভাবে এবং নিরলসভাবে সারাদিন গৃহকাজ সহ ছেলে-মেয়ে সহ অন্যান্য সদস্যদের সেবাযত্ন করেন; এটা সেই মহিলা অর্থাৎ একটা দারিদ্র্য পরিবারের মা যিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের পেট পুরে খাওয়ান এবং অবশিষ্টাংশটা তিনি শেষে খান। সুতারাং একজন মহিলা তাঁর পরিবারের সুখ সমৃদ্ধির স্বার্থে নিজের সব কিছুই ত্যাগ করেন। একদিকে যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাহ্যিক ও অভ্যান্তরীন বিষয়ে নারীর ত্যাগ ও অবদানের প্রমাণের কোনো অভাব নেই, অন্যদিকে নারী বঞ্চনা, নারী নির্যাতন, নারী-পাচার, নারীর বাণিজ্যিকীকরণ, জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তি সহ নারীর বাণিজ্যিকীকরণ, গৃহস্থালির ঝামেলা ইত্যাদি আমাদের নজর কাড়ে আর সেটা যে কোন সংবাদ পত্র খুললেই বোঝা যায়। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর প্রতি আমাদের শুধু অন্ধই করেনি বরং নারীর প্রতি আমাদের মানবিক কর্তব্য, নৈতিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাও কেড়ে নিয়েছে। এই ব্যাপারটা তখনই আমাদের চোখের সামনে ভাসে যখন পুরুষতান্ত্রিক যুবসম্প্রদায় এই ক্রমবর্ধমান আধুনিক যুগে বাসে বা ট্রেনে হাতে মোবাইল ও কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ভ্রমণ করে তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা সহ প্রবীণ যাত্রী দের বসতে দেওয়ার কথা চিন্তাও করেনা। সুতারাং আমাদের সরকার আজকে এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি উদযাপনের উদ্দেশ্যে একটা ছোট্ট উপহার হিসেবে গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চল সহ পুরো পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত যানবাহনে মহিলাদের বসার জন্য পর্যাপ্ত আসন সংরক্ষণ করার পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারেন ? (সমাপ্ত)
(লেখক রিসার্চ স্কলার, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট, আনন্দ, গুজরাত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct