ফরাসি নির্বাচন চলতি বছর, আগামী ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফ্রান্সজুড়ে ৪০টিরও বেশি প্রার্থী দেশের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রধান দলগুলি ফ্রান্সের পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি মুসলিম জনসংখ্যার কাছে কোনও আশ্বাসবাণী দেয়নি, বরং বছরের পর বছর ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধিতে সহায়তা দিয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে মুসলমানরা ভোট দেওয়ার যোগ্য কি না ও যোগ্যরা কোন নেতাকে ভোট দেবেন তা নির্ণয় হয়নি। এ নিয়ে লিখেছেন বজলুর রশীদ। আজ শেষ কিস্তি।
৫১ বছর বয়সী প্যারিসের বাসিন্দা হামুদ বেন বুজিদ ম্যাক্রোঁর পরিকল্পনা ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন কণ্ঠস্বরকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন; যাতে বৃহত্তর সমাজের কাছে এর বৈচিত্র্য দেখানো যায়। তিনি বলেন, ইমাম ও মুফতি সদস্যরা ফ্রান্সের প্রত্যেক মুসলিম নাগরিকের পক্ষে কথা বলেন না। বেন বুজিদ বলেন, আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করি, তা হলে কেন এই ফোরামকে প্রসারিত করা হবে না এবং ফ্রান্সে আরো অনেক মুসলমানের কণ্ঠস্বর শুনতে দেয়া হবে না। ‘আমি চাই, মুসলমানরা যেন এ দেশের নাগরিক হিসেবে থাকে, মুসলমান হিসেবে নয়। পূর্ণ নাগরিক হিসেবে।’ফোরামের সমর্থকরা বলছেন, এটি ফ্রান্সের পাঁচ মিলিয়ন মুসলমানকে নিরাপদ এবং বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে। সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র ইউরোপে মসজিদ নির্মাণে অর্থায়ন করে থাকে। ফোরাম বা নতুন সংস্থার লক্ষ্য ফ্রান্সের মুসলিম অনুশীলনগুলো যাতে জনজীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল চেতনা মেনে চলে তা নিশ্চিত করা। ম্যাক্রোঁর ফোরাম প্রকল্পে তুরস্ক, মরক্কো বা আলজেরিয়া থেকে মসজিদ-মাদরাসার কোনো ইমাম, মুফতি ও ধর্মীয় শিক্ষক আনার পরিবর্তে ফ্রান্সেই ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফোরামটি কারাগার, হাসপাতাল ও সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত ইমাম, আলেমদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মসজিদের নিরাপত্তার ওপরও জোর দিয়েছে। তাদের মতে, ইসলাম প্রজাতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তবে বিদেশী হস্তক্ষেপে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী মুসলমানরা ফ্রান্সের জনগণ; সুতরাং তাদের মূল দেশগুলোর সাথে আর কোনো যোগসূত্র নেই বা উচিত নয় এবং কেউই বোঝে না যে, বিদেশী রাষ্ট্রগুলো এই জাতীয় ইমামকে সরকারি কর্মচারী হিসেবে প্রাধান্য দেয়, যাকে বিচ্ছিন্ন ইমাম বলা হয়, বা ভর্তুকি দেয় বা উপাসনার জন্য জায়গা কিনে নেয়। আমরা যদি নির্বাচনের জন্য অন্যান্য প্রধান প্রার্থীর দিকে তাকাই, তবে তাদের বেশির ভাগই চরম ডানপন্থী ও ইসলামোফোবিক। মেরিন লে পেন, ইসলামোফোবিয়া এবং বিরোধী-সেমিটিক উভয় দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রাখার জন্য কুখ্যাত। তিনি নির্বাচনে ম্যাক্রোঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। লে পেন সব জনসভায় হিজাব নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করে থাকেন।
আরো বিস্ময়করভাবে, তিনি আরো বলেছিলেন যে, হিজাব ‘ইসলামী মতাদর্শের’ সাথে পোশাকের একটি টুকরা এবং হিজাবকে ‘সর্বগ্রাসী ও হত্যাকারী’ অভিহিত করে অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য দিয়ে ইসলামফোবিক দৌড়ে অগ্রভাগে রয়েছেন। এসব মন্তব্য ফ্রান্সের মুসলিম জনসংখ্যার জন্য গভীরভাবে ক্ষতিকারক ও আক্রমণাত্মক। অন্য প্রধান প্রার্থী, এরিক জেমুর, বর্ণবাদী এবং মুসলিমবিরোধী উভয় অনুভূতিই ছড়িয়ে দিয়েছেন। অতএব, আগামী নির্বাচন মুসলমানদের জন্য মোটেই সুখকর কোনো বিষয় হবে না। সমালোচকরা, যাদের মধ্যে অনেক মুসলমানও রয়েছেন, মনে করেন- এ ধর্মকে তাদের ফরাসি পরিচয়ের অংশ বলে মনে করেন; তারা বলছেন, সরকারের সর্বশেষ উদ্যোগটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য প্রক্রিয়ার আরেকটি পদক্ষেপ, যা কয়েকজনের সহিংস আক্রমণের জন্য সমগ্র সম্প্রদায়কে দায়ী করবে এবং তাদের জনসাধারণের জীবনে আরেকটি বাধা হিসেবে কাজ করবে। ফ্রান্সের মুসলমানরা মনে করে, তাদের কোনো প্রকৃত প্রতিনিধি নেই যে, তাদের প্রয়োজনের প্রতি যত্নশীল এবং তারা যাকেই বেছে নেবে তারা বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে দেশে প্রচলিত চলমান ইসলামোফোবিক আখ্যান চালিয়ে যাবে। ফরাসি মুসলমানরা উপনিবেশ ও দাসত্বের মুখোমুখি হয়েছিল আর এখন ওরা অত্যধিক প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের মুখোমুখি।
ম্যাক্রোঁর মুসলিমবিরোধী নীতি কখনো থেমে থাকেনি, ২০২০ সালে এক বক্তৃতায় ‘ইসলামী বিছিন্নতাবাদকে কঠোরভাবে দমন করবেন’ এবং ‘বিদেশী ইমাম ও শিক্ষকদের ইসলামী শ্রেণী শিক্ষা দান থেকে নিষিদ্ধ করবেন’ মর্মে ঘোষণা দেন। ম্যাক্রোঁর মতে ‘ফ্রান্সে রাজনৈতিক ইসলামের কোনো স্থান নেই’ এবং ‘ইসলাম সঙ্কটের মুখোমুখি’। ইসলামের সঙ্কট কেন ও কোথায় তার কোনো কারণ তিনি বলতে পারেননি। অথচ মাঝে মধ্যেই হিস্টিরিয়ায় আক্রান্তের মতো এমন কথা বলেন। উগ্র ডানপন্থী ভোটারদের কাছে টানার জন্য সম্ভবত তিনি এমন সব কথা বলেছিলেন, যা বাজারজাত করতে ব্যর্থ হন। আরো এক কারণ হলো- জাতীয় সমাবেশের সভাপতি মেরিন লে পেনকে তুষ্ট করার প্রচেষ্টা। ফ্রান্সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিভাজনের বীজ বপন করা হয়েছে, বছরের পর বছর এবং মূলত একটি ইসলামোফোবিয়ার চারণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, যার ফলে রাজনীতিবিদরা ভোট জয়ের জন্য একটি নির্বাচনী কৌশল হিসেবে মুসলমানদের আঘাত করাকে ব্যবহার করছেন। মুসলমানরা এবার পরবর্তী সময়ে দেশকে কে নেতৃত্ব দেবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় দু’টি মন্দের মধ্যে কোনটি কম সেটিই হয়তো বেছে নেবে। তবে ফ্রান্সের মুসলমানদের সামনে আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct