ফরাসি নির্বাচন চলতি বছর, আগামী ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফ্রান্সজুড়ে ৪০টিরও বেশি প্রার্থী দেশের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রধান দলগুলি ফ্রান্সের পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি মুসলিম জনসংখ্যার কাছে কোনও আশ্বাসবাণী দেয়নি, বরং বছরের পর বছর ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধিতে সহায়তা দিয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে মুসলমানরা ভোট দেওয়ার যোগ্য কি না ও যোগ্যরা কোন নেতাকে ভোট দেবেন তা নির্ণয় হয়নি। এ নিয়ে লিখেছেন বজলুর রশীদ। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর কিছু কিছু বিতর্কিত মন্তব্যও ইসলামবিদ্বেষকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মন্তব্য ফ্রান্সকে ইসলামী বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। ম্যাক্রোঁ খোলাখুলিভাবে ইসলামের নবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশকে নিরাপত্তা দিয়েছেন বিধায় মুসলমানরা নিন্দা জানিয়েছেন। এর আগে ম্যাক্রোঁ ঘোষণা করেছিলেন যে ‘ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা সারা বিশ্বে আজ সঙ্কটে রয়েছে’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দেশের অভ্যন্তরে ‘ইসলামী বিছিন্নতাবাদ’ এবং তার মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলে আসছেন। দেশের কিছু মুসলমান উদ্বিগ্ন যে সরকার তাদের ‘বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণের’ চেষ্টায় অনেক বেশি এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। ফ্রান্সের মুসলিমরা বলছেন যে, এ পদক্ষেপটি কয়েকজনের সহিংস হামলার জন্য পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা হচ্ছে। ফ্রান্সের মুসলমানরা দীর্ঘ দিন ধরে দৈনন্দিন জীবনে কলঙ্ক এবং চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ করে আসছেন। ফ্রান্সের মুসলিমরা বলছেন, ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী হামলার পর বৈষম্য আরো বেড়েছে। মুসলমানরা বলেছেন, ফরাসি সরকার ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদা করেছে কিন্তু খ্রিষ্টানদের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়ার সাহস করছে না। গত বছর ফ্রান্সের পার্লামেন্ট মসজিদ, স্কুল ও স্পোর্টস ক্লাবের ওপর নজরদারি জোরদার করতে একটি আইন অনুমোদন করেছে। সরকার যুক্তি দিয়েছিল যে, ফ্রান্সকে কট্টরপন্থী ইসলামপন্থীদের থেকে রক্ষা করার জন্য এ আইনের প্রয়োজন। আইনটি একাধিক মসজিদ এবং সংস্থা বন্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সমালোচকরা উপদেশ দিয়েছেন তিনি যেন নির্বাচনের আগেই ‘দ্য সিভিলাইজেশন অব আরব’ বইটি পড়েন।
ফ্রান্সের মুসলমানরা দীর্ঘ দিন ধরে দৈনন্দিন জীবনে কলঙ্কের অভিযোগ করে আসছেন, আইডি চেকের জন্য পুলিশ কর্তৃক একঘরে করা থেকে শুরু করে চাকরি অনুসন্ধানে বৈষম্য। যখনই উগ্রপন্থী সহিংসতা, বিদেশী বংশোদ্ভূত হামলাকারীদের দ্বারা বা ফরাসি বংশোদ্ভূত যুবকদের দ্বারা আঘাত হানে, তখন ফ্রান্সের নিজস্ব মুসলমানরা সন্দেহের মুখে পড়ে এবং সহিংসতার নিন্দা করার জন্য চাপে পড়ে। ইসলাম ফ্রান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, যেখানে কোনো একক নেতা এবং একাধিক স্ট্রেন প্রতিনিধিত্ব করে না। ফরাসি সরকার সম্প্রতি দেশের বৃহত্তম মুসলিম দাতব্য সংস্থা বারাকা সিটি এবং ফ্রান্সে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সমষ্টিগত আন্দোলনের সংস্থা, সিসিআইএফ বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম মুসলিম সম্প্রদায় ফ্রান্সেই রয়েছে এবং এটিকে গাইড করতে সাহায্য করার জন্য ফোরামের নেতৃত্ব প্রসিদ্ধ আলেম ও অন্যান্য সাধারণকে নিয়ে গঠিত হয়েছে। এর সব সদস্য সরকার বাছাই করেছে এবং এক-চতুর্থাংশ মহিলা সদস্য রয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ফ্রান্সে ইসলামের ফোরাম, জার্মানের ডয়েচে ইসলাম কনফারেন্সের (ডিআইকে) মডেলের এক প্রতিবিম্ব, এই ফোরাম সদস্যরা প্রতি বছর মিলিত হবে প্রয়োজন অনুসারে। ম্যাক্রোঁ মনে করেন এই ফোরাম চরমপন্থাকে নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। এ জন্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে প্রকাশ্যে প্রতিপালন না করাই শ্রেয়। ফ্রান্সে ৩৫ শতাংশ সেকুলার ভাবধারার। তাদের রক্ষার জন্য সংবিধানের ১ ধারায় বিধি বর্ণিত রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী, ধর্মহীন গোষ্ঠী, নাস্তিক, বাহাই জাতীয় সর্বধর্মে বিশ্বাসী গোষ্ঠী যারা মূলত কোনো ধর্মাচার করে না।
ফরাসি সরকার ধর্মকে চরমপন্থা থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে ফ্রান্সে ইসলামকে নতুনভাবে আকার দিতে ২০০৩ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজি ফরাসি কাউন্সিল অব মুসলিম ফেইথ নামে সংস্থা বানিয়েছিলেন। ম্যাক্রোঁ সে সংস্থাকে আরো কঠিন নিয়মকানুন যোগ করেছেন। মুসলিম ফেইথ কাউন্সিল বহু বছর ধরে ফরাসি সমাজে তার অবদান রেখেছে। তার পরও ফ্রান্সে দিন দিন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফরাসি সরকারের মতে, এখন তারা বড় সমস্যার সম্মুখীন। ধর্মীয় ফেডারেশনগুলোর কার্যকারিতায় বিদেশী রাষ্ট্রের অর্থ ও প্রভাব বেশি কাজ করছে। ফ্রান্সের ফোরাম অব ইসলাম নামের নতুন সংস্থাটির সমর্থকরা বলছেন, এটি দেশ এবং তার ৫০ লাখ মুসলমানকে নিরাপদ এবং বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে; নিশ্চিত করবে যে, ফ্রান্সে মুসলিম অনুশীলনগুলো জনজীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার দেশের লালিত মূল্য মেনে চলে।
(ক্রমশ...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct