প্রযুক্তির হাত ধরে কম্পিউটার আসায়, এখন লেখা বা আঁকার কাজ অনেকটাই সহজ হয়েছে। দোকান ঘরের সামনে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে এখন কম্পিউটারাইজড ফ্লেক্স, গ্লো সাইন বোর্ড এর ব্যবহার। এমনকি সাংস্কৃতিক মঞ্চ, সভা, সমিতি, মিছিল প্রভৃতি ক্ষেত্রে এখন ফ্লেক্স এর ব্যবহার সর্বজনবিদিত। বাস, ট্রাম, ট্যাক্সি, লরিতেও আজকাল নম্বর প্লেট থেকে শুরু করে পুরো শরীর জুড়ে স্টিকারের প্রচলন। সে লেখা হোক বা আঁকা। এ নিয়ে লিখেছেন নরসিংহ দাস।
হাতেখড়ি’ খুবই প্রাচীন এক পদ্ধতি। ছোট হাতের মধ্যে খড়ি ঢুকিয়ে শিক্ষক আঙুলকে চেপে ধরে জীবনের প্রথম লেখা ‘অ আ’ লিখতে শিখিয়েছেন কাঠের ফ্রেমে বাঁধা স্লেটে। এই প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে ধারাবাহিক ভাবেই। উদ্দেশ্য একটাই, লেখাপড়ার প্রাথমিক পর্যায়ে লেখার গুরুত্ব আগে, তারই শুভারম্ভ। তারপর থেকেই আমরা লিখতে শুরু করি। হাতের লেখা ভালো করার উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ‘হস্তাক্ষর’ লেখা রুটিনমাফিক কাজ ছিল। বেশিরভাগই বাঁশের কলম ও দোয়াতের কালি ব্যবহার করা হতো। পরে এল বলপেন, তবুও ঐ হস্তাক্ষর নিয়ম চালু ছিল ও বর্তমান আছে। একই সঙ্গে ফল, পশু, পাখির ছবিও আঁকতে হতো। অতএব লেখা ও আঁকা শিক্ষা ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক অধ্যায়।
যিনি যত বড় পদে থাকুন না কেনো, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতেই হয়। আর পরীক্ষা ক্ষেত্রে হাতের লেখা তো রয়েছেই, বিষয়ভিত্তিক আঁকারও গুরুত্ব রয়েছে। পড়াশোনা করেই যে সবাই শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার হবে এমন কোন কথা নেই। অন্যান্য পেশা ও জীবিকার মতো হাতের লেখা ও আঁকার উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা যায়। গত তিনদশক আগে পর্যন্ত এই বিষয়ের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন অনেকেই। অনুষ্ঠান মঞ্চ, সভা সমিতি, মিছিলে নীল কাপড়ের উপর, দোকানঘরের সামনে, যানবাহনের গায়ে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আদালত, ব্যাঙ্ক ও প্রশাসনিক ভবনের মূল ফটকের উপর রং তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হতো বিষয়ভিত্তিক লেখা। ঐসব লেখা বা আঁকার জন্য এলাকাভিত্তিক কয়েকজন বেশ পরিচিত ছিলেন। আর ঐ পেশার উপর নির্ভর করে অনেকেই জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রযুক্তির হাত ধরে কম্পিউটার আসায়, এখন লেখা বা আঁকার কাজ অনেকটাই সহজ হয়েছে। দোকান ঘরের সামনে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে এখন কম্পিউটারাইজড ফ্লেক্স, গ্লো সাইন বোর্ড এর ব্যবহার। এমনকি সাংস্কৃতিক মঞ্চ, সভা, সমিতি, মিছিল প্রভৃতি ক্ষেত্রে এখন ফ্লেক্স এর ব্যবহার সর্বজনবিদিত। বাস, ট্রাম, ট্যাক্সি, লরিতেও আজকাল নম্বর প্লেট থেকে শুরু করে পুরো শরীর জুড়ে স্টিকারের প্রচলন। সে লেখা হোক বা আঁকা।
তবে কিছু কিছু জায়গায় এখনও তুলি দিয়ে লেখা বা আঁকার প্রচলন রয়েছে। মাইলস্টোন, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ফলক, বনবিভাগের সাবধান সূচক ফলক প্রভৃতি ক্ষেত্রে হাতে লেখা বা আঁকার প্রাধান্য দেখা যায়। তবে তা সংখ্যায় নগন্য। অন্যদিকে মোবাইল ও কম্পিউটারে টাইপ করে ছাপা সহজলভ্য ও সৌখিন হওয়ায় হাতে লেখার গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। তিন দশক আগেও নিমন্ত্রণ পত্র, আবেদন পত্র, দলিলনামা প্রভৃতি লেখার জন্য ভালো হাতের লেখার গুরুত্ব ছিল। সেই জায়গায় এসেছে এখন কম্পিউটারাইজড টাইপ। লেখার গুরুত্ব পরীক্ষার উত্তরপত্র পর্যন্ত ও আঁকার গুরুত্ব ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এমনকি কোথাও কোথাও এখন নিজের স্বাক্ষর করাটাও স্ট্যাম্পে পরিবর্তিত হয়েছে। শংসাপত্রও আজকাল আর হাতে লেখা হয় না। ফলস্বরূপ হাতের লেখা ও আঁকার উপর যাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁরা অন্য কোন পেশাকে বেছে নিয়েছেন। আর শিক্ষাক্ষেত্রেও লেখা ও আঁকার গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। ভবিষ্যত না থাকায় হাতে লেখা ও আঁকার গুরুত্ব হারিয়ে যেতে বসেছে ধীরে ধীরে।
লেখক শিক্ষক, এলাহিয়া হাই মাদ্রাসা (উঃ মাঃ), পশ্চিম মেদিনীপুর।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct