আমার প্রথম স্বপ্ন
তাপস মুখোপাধ্যায় (বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার)
_____________________________
আমি তখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। এক বন্ধু প্রতিদিন টিফিনের সময় ব্যাগ থেকে একটা করে বাপুজি কেক বের করত। আশির দশকের সেই সময় বহু ছাত্রের দিনে পেটভরা খাবার জুটত না। টিফিনের কেক সে সময়ে এক বিলাশিতা ছিল আমার মতো বহু গ্রাম্য ছাত্রদের জীবনে। আমি কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। জানালার ঝাপসা কাঁচ আর ঝাপসা হয়ে আসা চোখে তখন সীমাহীন পৃথিবীর আকাশটাকে অস্পষ্ট লাগত। ক্ষনিকের নীরবতার পর লক্ষ্য করতাম বন্ধু আমার খাতার ওপর একটুকরো কেক রেখেছে। কেক খেতে খেতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর স্বপ্ন দেখতাম একদিন টিফিনে বাপুজি কেক নিয়ে আসার। সেই আমার জীবনের প্রথম স্বপ্ন। বাবা মা কে বলতে না পারায় আমার সেই স্বপ্নও অধরা ছিল বহুদিন। চোখের জলের কাছে নয়, স্বপ্ন ধরা দেয় পরিকল্পিত, নিরলস কর্মের কাছে।
একদিন নিজের কম্পিত কন্ঠস্বরকে সঙ্গী করে বাবা মাকে জানালাম আমার স্বপ্নের কথা। মা তত্ক্ষণাত্ বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন “হ্যাঁ, অবশ্যই নিয়ে যাবি। এটা কোন সমস্যাই নয়”। মায়ের মন সন্তানের সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে চায়। বাবা ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তিনি খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে বললেন, “there is no free lunch in this world. You need to earn your cake”. ইংরেজি শব্দের সঠিক বাংলা রূপান্তর না করেও বুঝেছিলাম বাবা মায়ের সঙ্গে সহমত নন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে বাবার দ্বিতীয় বাক্যের মানে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম যখন বাবা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আলোচনা দীর্ঘায়িত হবে না। আগামী পরীক্ষায় স্থানীয় পাঁচ স্কুলের সমস্ত ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে যদি প্রথম তিন স্থানের মধ্যে নিজেকে আনতে পার, তোমায় কেক দেওয়া হবে “। সান্ধ্য অন্ধকার আকাশের শুকতারার মতোই অনিশ্চয়তার মাঝে একটুখানি আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম বাবার কথায়। মানসিক ইচ্ছা না থাকলেও মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। পরীক্ষার পর যেদিন প্রথম কেক নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলাম সেদিন মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি দোলা দিচ্ছিল। টিফিনের সময় সেই কেক এর একটা বড় অংশ বন্ধুকে দিয়েছিলাম। একটুকরো কেক নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম জানালার দিকে। ঝাপসা কাঁচ আর ঝাপসা হয়ে আসা চোখেও লক্ষ্য করেছিলাম সৌরজ্জল নীল আকাশের অপূর্ব সৌন্দর্য।
বাড়ি ফিরে বাবাকে মনের আনন্দের কথা জানাই। মুখে কোন দিন প্রকাশ না করলেও বুঝেছিলাম সেদিন বাবার সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল। ক্ষনিকের কঠিন পথ যখন ভবিষ্যতকে মনোরম পরিবেশে নিয়ে যায় তখন সেই পথেই জীবন পরিচালনা বাঞ্ছনীয়। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “what is ONE THING you will achieve next year?” তখন আমি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। বুঝতে পারিনি বাবার সেই সহজ প্রশ্ন আমার জীবনে এক বড় ভূমিকা নেবে। প্রতিবছর জানুয়ারি মাস শুরুর আগে একবার করে এই প্রশ্নটার উত্তর লিখি। নিজেকে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ করি বাপুজি কেক খাওয়ানোর। লক্ষ্য স্থির করতে অনুপ্রাণিত করা ও লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করে তোলা সন্তানের জীবনে পিতামাতার এক সুন্দর উপহার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct