উদ্ভাসিত অঙ্গনে আমার একুশ
নন্দিনী আরজু রুবী
_________________
মধ্য রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয়াল ঘড়িটাতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বেজে গেল। প্রপিতামহদের আমলের ঘড়ি বহু পুরাতন। এখনো ঠিক সময় দেয়। কাঠের বড় পেণ্ডুলাম দুলেদুলে ঘোষণা করে সময়ের কাঁটায় ঢং...ঢং। শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে,শব্দ না শুনলে ফাঁকা লাগে। স্বাতী নিবিষ্ট মনে প্ল্যাকার্ডে রঙ দিয়ে অক্ষর লিখছে। বিভিন্ন রঙের লাল রঙই বেশি। মা অনেকক্ষণ আগেই ঘুমুতে বলে গেছে।কিন্তু ঘুমুতে পারবে না সে কাজ শেষ না করে।
স্বাতী তার পুরুলেন্সের চশমাটা একটু মুছে নিলো আর মাত্র কয়েকটা প্ল্যাকার্ড লেখা বাকি। কলেজের বন্ধুরা মিলে এবার একুশে ফেব্রুয়ারীতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার চত্বরে আল্পনা আর প্রভাতফেরির জন্য বিভিন্ন ব্যনার প্লেকার্ড তৈরী করছে।
হঠাৎ ইলেক্টিসিটি চলে গেলো, “উফফ কাজের সময় বিরক্ত লাগে ধ্যাৎ।” চার্জার লাইটাও মা-বাবার ঘরে, এতো রাতে ডেকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছে না।
সে দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিলো, বাহিরে ম্লান চাঁদের আলো ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা বাতাস এক নিমিষে ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো বসন্ত রাতের মায়াবী রূপ ভালো লাগছে। বড়রাস্তার ধারে কৃষ্ণচূরার লালফুল চাঁদের ম্লান আলোতেও চোখে পড়লো। রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর ডাক শুনতে পাচ্ছে স্বাতী।
কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়লো সে। স্মৃতি গুলো আজও জীবন্ত, দগ্ধে দগ্ধে ভীষণ মনে পড়ে হামিদুরের কথা।গত তিন বছর হলো সে আর নাই। কোনো এক বইমেলায় তার সাথে পরিচয় এবং পরে বিয়ে।তখন সবে যৌবনে পা দিয়েছে স্বাতী। সে নেই, কখনো ফিরবে না,কোনদিন না!
তবুও ফেব্রুয়ারী এলেই ভিড় করে নানা স্মৃতি,দুজনে ফুলের তোড়া হাতে শ্রদ্ধা জানাতে যেতো।রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আরও কত উৎসব আয়োজনে যোগ দিয়েছে একসাথে। আজ স্বাতী বড় একা।
সে নতুন করে পড়া-লেখা শুরু করেছে আবার। বরাবর ছবি আঁকায় সে ভীষণ ভালো ছিলো এখন একাত্ম হয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে আঁকা-আঁকিতে। ভালো লাগে তার সময়ও কেটে যায়।
সকালের আগেই সব রেডি করতে হবে। খুঁজে পেতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলো সে। কাঁপাকাঁপা আলোয় পেইন্টিং করা অক্ষর গুলো যেন একটু একটু কোরে জীবন্ত হয়ে উঠছে। মুগ্ধচোখে স্বাতী দেখছে বর্নীল বর্ণমালা! অক্ষর। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় ফিরে গেলো অতীতের ইতিহাসে।
সেই গর্বিত আত্মত্যাগ, ভাষার জন্য নিঃস্বার্থ আত্মদান। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী, জাতির সূর্য সন্তান বাংলাভাষার জন্য দিয়েছে প্রাণ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সমুন্নত গৌরব শিখা অনির্বাণ চিরভাস্বর।
সে নিমগ্ন রঙ-তুলি নিয়ে। মোমের আলোয় এঁকে চলেছে অক্ষর। ঘড়িতে একটা বাজলো, কাজ প্রায় শেষ! এখনো ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি কাজের ভিতরে ভাবনায় তলিয়ে গেলো ...
ঠকঠক সজোরে কড়া নাড়ছে, “কই হ্যায়..,” ভয়ংকর কন্ঠে হাক দিলো কেউ!
পরক্ষণেই প্রচণ্ড জোরে দরজায় বুটের লাথি, থরথর করে কেঁপে উঠলো গোটা বাড়ি, পাকমিলিটারির উর্দূতে হুংকার আর গালাগাল। স্বাতী অনুভব করছে সেইসব দিন...
যেন নিজের সাথেই ঘটে চলেছে সব। হঠাৎ বাতি নিভে গেলো ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুনতে পাচ্ছে বিজাতীয় ভাষার চিৎকার। অন্ধকারে স্বাতীর হাত ধরলো হামিদুর, চমকে উঠলো সে ! এসব কি ভাবছে!
অন্ধকারে সে আবার ভাবনার অতলে তলিয়ে গেলো...
ভোরের আলোয় এগিয়ে আসছে মিছিল, ক্ষুব্ধ বজ্রমুষ্ঠি,শ্লোগানে আকাশ কাঁপিয়ে হাতে হাতে প্ল্যাকার্ডে বাংলা বর্ণমালা। সূর্য সন্তানরা আসছে, “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই “ নির্ভিক দীপ্ত পদভারে রাজপথ মুখর।স্বাতী দেখলো
মিছিলে হামিদুর, চেনা প্রিয় সব মুখ। সবাই দাবিতে সোচ্চার বাংলাভাষা চাই...। স্বাতী অস্ফুটে আঁতকে উঠল
ওরা সবাই যেন ইতিহাসের অংশ, সে শুনতে পাচ্ছে বুটের আওয়াজ, রাইফেলের ট্রিগার টানার শব্দ।
চারিদিকে চোখ ধাঁধানো লাল, স্বাতী দিশেহারা, আকাশ গলে পড়ছে! উদিত সূর্য ঢেকে বাজপাখির আগ্রাসন। ধেয়ে আসছে কেড়ে নিতে ভাষা! অপশক্তির কালো থাবা।
ঠা-ঠা বুলেটের শব্দ আর্তচিৎকার, রক্তস্রোতে ভাসছে মিছিল। ভীষণ-উৎকণ্ঠা, শোকের ঘূর্ণি তবু চোখে হার না মানা দীপ্তভাষা।
থামো, অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠলো স্বাতী, উফফ্ কী ভীষণ বিভিষিকা,অমানুষিক বর্বরতা। প্রিয় মুখ গুলো রক্তে ভাসছে তার পেইন্টিং করা অক্ষরের মতো। স্বাতী বিড়বিড় করে বলছে,
“আমাদের কথা চাই, ভাষা চাই, বর্ণমালা চাই...
আমি লিখবো পড়বো গাইবো!”
রক্তে ভিজে গেছে সব অক্ষর,ছত্রভঙ্গ মিছিল পড়ে আছে লাশ। অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার হাজারো সূর্য যেন জ্বলছে লাল স্রোতে!
ভাবনার অতলে নিরন্তর আঁধারের আধিপত্য ভেঙেচুরে রক্তস্রোত থেকে স্বাতী তুলে নিলো বর্ণ,অজস্র শব্দ মায়ের জন্য যত ভাষার অলংকার...
স্বাতী যেন ছুটছে লক্ষ কোটি মায়ের কাছে,
“মাগো, কথা এনেছি দেখো! ভাইরা ভাষার মুকুট ছিনিয়ে এনেছে শুধু তোমাদের জন্য মা।”
বিস্মিত সে, চমকে দেখলো ইলেক্ট্রিসিটি এসেছে। ঢং...ঢং দেওয়াল ঘড়ি জানান দিলো পাঁচটা বাজে। স্বাতীর চোখে জল,ঘরময় আলোয় জ্বলজ্বল করছে প্ল্যাকার্ডের অক্ষর। ভোর হয়ে এসেছে আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে।
ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে বোতল থেকে পানি খেলো। মা ডাকছেন,
“স্বাতী ওঠো সকাল হয়ে গেছে।”
সে বাস্তবতায় ফিরে এলো।
সারারাত ঘুমায়নি, ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেছিলো। এখনও অনেক কাজ বাকি।
শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে আল্পনা আঁকলো সব বন্ধুরা মিলে। কাল একুশে ফেব্রুয়ারি।
খুব ভোরে লালপেড়ে সাদাশাড়ি খালি পায়ে হাতে গোলাপের তোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লো স্বাতী। ভোরের হিমেল হাওয়া প্রকৃতিতে বসন্তের ছোঁয়া গাছে নতুনপাতা আর রঙবেরঙের ফুল। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে চিৎকারে চিৎকারে আকাশ বাতাস মুখরিত করতে।সে দেখতে পেলো বন্ধুরা সব ফুল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড হাতে এগিয়ে আসছে। চারিদিক থেকে অনেকেই যোগ দিচ্ছে প্রভাতফেরিতে। একুশের গান গাইতে গাইতে ধীরলয়ে এগিয়ে চলেছে সবাই। ফুলে ছেয়ে গেছে বেদিমূল। শ্রদ্ধা, ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদনে অবনত সব প্রাণ। শহিদমিনারে লাল বৃত্তের ভিতর ফুটে আছে অ, আ, ক, খ, “তোমাদের ভুলিনি আমরা কখনো ভুলবো না।”চেচিয়ে বললো স্বাতী।
সবাই সচকিত হয়ে ফিরে তাকালো! তখন স্বাতীর উদ্ভাসিতমুখে অন্য এক আলো...।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct