মধ্যমগ্রাম রেলস্টেশনে একদিন
শংকর সাহা
__________________
আজ মধ্যমগ্রাম স্টেশনে যেতেই নবনীতার মনে পড়ে গেলো সেই সময়গুলোর কথা, মনে পড়ে গেল সৌম্যের কথা যা আজও স্মৃতি হয়ে বারে বারে ফিরে আসে তার কাছে।
দেখতে দেখতে সময় আজ অনেকটাই পেরিয়ে গেছে তবুও সৌম্যের মূল্যবোধ আজও তার মনে যেন বাস্তবের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠে।
আজ থেকে তিনবছর আগে এই স্টেশনেই প্রথম দেখা হয় নবনীতার সাথে সৌম্যের।
চাকুরি সূত্রে উল্টোডাঙায় থাকতো বছর সাতাশের যুবক সৌম্য। প্রতিদিন লোকাল টেনেই স্কুলে যেতে হতো তার। স্কুল শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখিতে তার ছিল বেশ নামডাক। ‘দেশ’ পত্রিকায় পুজো সংখ্যা বের হতেই শহর কলকাতার লেখকদের পাশাপাশি আজ তাকেও চিনতে শিখেছেন সকলে।
এমনই একদিন লোকাল ট্রেনে করে মধ্যমগ্রাম স্কুলে চাকুরির উদ্দেশ্যে যাবার
পথে হঠাৎ নবনীতার সাথে পরিচয় হয় সৌম্যর। পাশাপাশি একসিটে বসে গেলেও তেমন কথা হয়নি তাদের।
একদিন সিটে অনমনা হয়ে হাতে রাখা ম্যাগাজিনটি পড়ছিল সৌম্য। হঠাৎই পাশ ফিরে নবনীতা হেসে বলে,
‘আপনি, ম্যাগাজিন পড়তে ভালোবাসেন বুঝি ? প্রায় দেখি আপনাকে কিছু না কিছু
পড়তে। জানেন তো আমিও এক সময়ে প্রচুর গল্পের বই পড়তাম “
কিঞ্চিত হেসে সৌম্য বলে,
“ সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তাই পড়ার নেশাটা আজও ছাড়তে পারিনি। এই অচেনা শহরে রবিঠাকুরকে আঁকড়ে ধরেই তো বাঁচতে শিখেছি.. ‘
‘আপনি তবে কোথা থেকে এসেছেন ? থাকেন কোথায়?’
এভাবেই ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সৌম্য আর নবনীতার মধ্যে।দুইজনে
একসাথে যাওয়া, শনিবারে স্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা পথ চলা। কোথাও হলে তাদের বন্ধুতবের মাঝে এক বিশ্বাস গড়ে উঠতে থাকে।
নবনীতার বাবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী। বাবার আদর্শে মানুষ হয়ে ওঠা তার।
একদিন সৌম্যকে বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা বলতেই সৌম্য হেসে বলে,
‘নবনীতা, তোমার বাবা যদি জানতে চান কে হই আমি কি বলবে ওনাদের ?’
নবনীতা হেসে বলে, ‘কেন ভালো বন্ধু হয়ে যাবে আমাদের বাড়ি।‘
সত্যিই সময়গুলো কেমন করে যেন পেরিয়ে গেল কত তাড়াতাড়ি। কত গল্প যেন জমা ছিল তা হয়তো আজ নবনীতার না বলাই রয়ে গেল।
সেদিন বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেতে বসে রবি ঠাকুরের গল্প গুচ্ছ পড়ছিল সে হঠাতই
মোবাইলে সৌম্যের মেসেজ,
‘নবনীতা, আজ মেসে এসে দেখি আমার ট্রান্সফারের লেটারের কপি চলে এসেছে।
পরশু নতুন স্কুলে জয়েনিং। হয়তো কাল সকালের ট্রেনেই চলে যেতে হবে বাড়ি। ‘
মেসেজটি পড়তেই নবনীতা চমকে উঠে।
‘কালই সৌম্য,তবে যে আমি....!’
সৌম্য উত্তরে জানায়, ‘সরি নবনীতা, আমিও বুঝতে পারিনি এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। চিন্তা করোনা আমি ডিসেম্বরই আবার আসবো। সেই মন্দিরে যাবো মাকে প্রণাম করতে। তুমিও থেকো সাথে.. ‘
নবনীতার চোখটি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। সৌম্যকে দেবে বলে সে যে কতো বই কিনে রেখেছে। ছেলেটি যে বড্ড বইপোকা!
রাত্রি তখন এগারোটা বেজে পার। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি।আজ যে নবনীতার মনটি বড়ই ব্যাকুল হয়ে নি:শব্দে বলে চলেছে,
‘সৌম্য আর কিছুটা সময় থেকে যাও, তোমায় যে না বলা অনেক কথা জমা আছে.. “
আজ তার কষ্টগুলো যেন নীরবে তাকে বড্ড আঘাত করছে নবনীতা বুঝতে পারে সে অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছে। আজ তার সৌম্য তাকে ছেড়ে
পাড়ি দেবে অনেক দূরে। সেই মিস্টিভাষী ছেলেটি আর যে তার জন্যে অপেক্ষা করবে না দাঁড়িয়ে রেল স্টেশনে।
এক চাপা কষ্ট তাকে যে অস্থির করে তুলেছে। নবনীতা বুঝতে পারে সেই পথে সে আর যেতে পারবে না কাল থেকে যেখানে সৌম্যের হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
সে চাকুরিটি ছেড়ে দেবে। যে সৌম্যর মাঝে খুঁজে পেয়েছিল এক বেঁচে থাকার
অনুপ্রেরণা আজ তার অবর্তমানে সেই পথে সে আর ফিরবে না...
আজ যে তার চোখে ঘুম নেই। বাইরে বৃষ্টির বেগও বেড়েছে হঠাৎই সৌম্যের
জন্যে মনটি অস্থির হয়ে ওঠে। হাতে মোবাইলটি নিয়ে তাকে একবারও বলতে পারছে না,
“আর কিছুদিন থাকবে না সৌম্য,
কাল যদি একটিবার দেখা হয় মধ্যমগ্রাম রেলস্টেশনে...!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct