যুদ্ধের অধিকার একক কোনো রাষ্ট্র কিংবা যুদ্ধবাজ সমরনায়কদের নিয়ে গড়ে ওঠা কোনো জোট কিংবা বলয়ের নেই এবং তা থাকতে পারে না। এখানেই মনে হয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। ইউক্রেন কিংবা তাইওয়ানকে ঘিরে দেখা দেওয়া উত্তেজনায় আমরা, বিশেষ করে আমাদের সংবাদমাধ্যম অজান্তেই হয়ে উঠছি যুদ্ধের একটি পক্ষ। ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করছি যে পক্ষের হয়ে কথা আমি বলছি, সেই পক্ষের অবস্থানকে যুক্তিসংগত প্রমাণ করতে। সাম্প্রতি পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন মনজুরুল হক। আজ শেষ কিস্তি।
একালে যুদ্ধ যে সবাই করছে, তা অবশ্য নয়। যুদ্ধ যারা করছে এবং যুদ্ধের পেছনে মূল মদদ যারা দিয়ে চলেছে, সেই তালিকা কিন্তু খুবই সীমিত। তবে সংখ্যায় সীমিত হলেও অর্থ এবং সমরবলের দিক থেকে এদের ধারেকাছে অন্য কেউ না থাকায় যুদ্ধকে এরা ধরে নিচ্ছে নিজের একতরফা এখতিয়ার হিসেবে এবং অন্য কেউ সেই পথে পা বাড়ানোর চেষ্টা করলে মুহূর্তেই এরা চড়াও হচ্ছে তাদের ওপর। চলতি শতকের সূচনালগ্নে ইরাক ও লিবিয়া এবং আরও কিছুটা পরে আফগানিস্তানে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাবলি সেই প্রমাণ দিচ্ছে না কি? ইরান যেন কোনো অবস্থাতেই নিজের সমরবল বৃদ্ধি করতে না পারে, সেই চেষ্টা পশ্চিমের শক্তিধর দেশগুলো করে যাচ্ছে পাঁচ দশক ধরে। অথচ নিজেদের শক্তির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার কোনো ইচ্ছা এদের আদৌ আছে বলে এখনো প্রমাণিত হয়নি। যুদ্ধ নিয়ে এ রকম কানামাছি ভোঁ ভোঁ চলতে থাকা অবস্থায় পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ জানানো শক্তি হিসেবে রাশিয়ার ময়দানে ফিরে আসা এবং চীনের উত্থান সাম্প্রতিক সময়ে সনাতন যুদ্ধবাজদের দুশ্চিন্তা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে সেই দুই দেশকে ঠেকাতে নিজেদের বরকন্দাজদের এরা এখন লেলিয়ে দিচ্ছে রাশিয়া এবং চীনের বিরুদ্ধে। পূর্ব ইউরোপে পশ্চিমের নতুন বরকন্দাজ ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তেজনা। অন্যদিকে পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমের বরকন্দাজ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে তাইওয়ান। ফলে এখানেও থেমে নেই যুদ্ধপ্রস্তুতি, যে প্রস্তুতির সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো কয়েকটি দেশ। তবে কেউ কিন্তু বলছে না কোথায় আমাদের নিয়ে যেতে পারে এ রকম হুংকার তোলা যুদ্ধের প্রস্তুতি, যেটাকে অন্যভাবে সহজেই ‘ফোনি ওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। ইংরেজি শব্দ ‘ফোনি ওয়ার’ যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি পরিস্থিতির বেলায় ব্যবহার করা হয়।
প্রথমটি হল যুদ্ধ চলতে থাকা সময়ে সংঘাতের মাত্রা হ্রাস পাওয়া এবং অন্যটি হচ্ছে আপাতদৃষ্টে শান্তি বিরাজমান থাকার সময়ে ক্রমশ তীব্র হয়ে আসা যুদ্ধপ্রস্তুতি। ইউক্রেন ও তাইওয়ানকে কেন্দ্রে রেখে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন জোটের সামরিক মহড়া চালানো এবং সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি নিজের মিত্রদের অস্ত্রবলে সজ্জিত করায় প্রকাশ্যে চালিয়ে যাওয়া তৎপরতা এই দ্বিতীয় অর্থের ‘ফোনি ওয়ার’কেই মনে করিয়ে দিচ্ছে, যেটা কিনা উচ্চ স্বরে বেজে চলা যুদ্ধের ডঙ্কার আওয়াজকে করে তুলছে আরও অনেক বেশি ভীতিকর। ইউক্রেন কিংবা তাইওয়ানকে ঘিরে আরও একটি সর্বগ্রাসী যুদ্ধ বিশ্বে শুরু হতে যাচ্ছে কি না এবং সেই যুদ্ধ শুরু হলে কে হবে বিজয়ী আর কে হারিয়ে যাবে পরাজিত শক্তি হিসেবে ইতিহাসের অন্ধকারে, সেই হিসাব সমরবিশারদেরা সমানে করে গেলেও বিশ্বজুড়ে এখন বড়ই আকাল চলছে শান্তিকামী মানুষের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের। কোথাও এখন আর দেখা মিলছে না পিকাসোর মতো প্রত্যয়ী মানুষের, যাঁরা কিনা যুদ্ধবাজদের মুখের ওপর বলে দিতে পারবেন, ‘অনেক হয়েছে, ধ্বংসের আগুনের দিকে সবাইকে ঠেলে দেওয়ার আগে অন্তত এই ছবির দিকে তাকিয়ে এবারে একটু ক্ষান্ত দাও।’ আর এরা নেই বলেই যুদ্ধ এখন যেন হয়ে উঠছে আরও বেশি অবশ্যম্ভাবী; যদিও আমরা সবাই জানি সর্বগ্রাসী যুদ্ধ আবারও শুরু হলে এর ভয়ংকর পরিণতি থেকে নিস্তার পাওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না। (সমাপ্ত...)
লেখক জাপান প্রবাসী শিক্ষক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct