যুদ্ধের অধিকার একক কোনো রাষ্ট্র কিংবা যুদ্ধবাজ সমরনায়কদের নিয়ে গড়ে ওঠা কোনো জোট কিংবা বলয়ের নেই এবং তা থাকতে পারে না। এখানেই মনে হয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। ইউক্রেন কিংবা তাইওয়ানকে ঘিরে দেখা দেওয়া উত্তেজনায় আমরা, বিশেষ করে আমাদের সংবাদমাধ্যম অজান্তেই হয়ে উঠছি যুদ্ধের একটি পক্ষ। ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করছি যে পক্ষের হয়ে কথা আমি বলছি, সেই পক্ষের অবস্থানকে যুক্তিসংগত প্রমাণ করতে। সাম্প্রতি পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন মনজুরুল হক। আজ প্রথম কিস্তি।
ভালো নেই আমাদের এই ধরিত্রীর স্বাস্থ্য। মানুষের লাগামহীন লালসার চাপে দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার অবস্থা আমাদের চারপাশের পরিবেশের। অন্যদিকে কেবল মারা যাওয়া নয়, চিরদিনের জন্য এই জগৎ থেকে নিয়মিত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অগণিত প্রজাতি এবং সেটাও হচ্ছে আমাদের অফুরান আকাঙ্ক্ষার ফাঁদে অজান্তে পা দিয়ে। অন্যদিকে আমরা যারা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বুক চিতিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করি না, তারাও ভালো নেই নানা চাপের মধ্যে পিষ্ট হয়ে বেঁচে থেকে। চোখে না দেখা করোনাভাইরাস জীবাণু দেখিয়ে দিয়েছে নিজের সাফল্য নিয়ে গৌরব বোধ করার কিছুই আমাদের নেই, কেননা, এর সবটাই ঠুনকো এবং মুহূর্তের ভুলে ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে আমাদের সব রকম হিসাব-নিকাশ। সভ্যতার সেই সূচনালগ্ন থেকে বারবার হোঁচট খেয়েও সেই বোধোদয় যে আমাদের আজও হয়নি, বিশ্বরাজনীতির সাম্প্রতিক গতিবিধি মনে হয় সে কথাই আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল বিশ্বের পাঁচ কোটির বেশি মানুষ। যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের কারণে আরও যে কয়েক কোটিকে প্রাণ দিতে হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, সেই হিসাব অবশ্য এর মধ্যে ধরা হয়নি। ফলে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা হবে আনুষ্ঠানিক হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। হিসাবের বাইরে থেকে যাওয়া এসব মৃত্যুর বড় এক অংশ যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক দূরে ঘটে যাওয়ায় সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে একসময় যারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, এদের অনেকেই যুদ্ধ যে কী, তার কোনো হদিস কখনোই করে উঠতে পারেনি।
ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথাই ধরুন। অনেকেই এখন এর জন্য চার্চিলের বর্ণবাদী আচরণকে দায়ী করে থাকেন। তবে যে সত্য আমরা এড়িয়ে যেতে পছন্দ করি তা হলো, চার্চিল তাঁর এই নীতি বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন দেশের ভেতরের একটি শ্রেণির সহযোগিতা নিয়ে, বাংলার মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে খাদ্যের চালান যাঁরা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যুদ্ধ ফ্রন্টে এবং সেই সেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন ধনকুবের এবং সেটা হয়েছিলেন লাশের ওপর পা ফেলে। অন্যদিকে প্রাণ যারা হারিয়েছে, তারা ভাবতেও পারেনি যে তাদের সেই করুণ পরিণতির পেছনে ছিল দূরে কোথাও চলতে থাকা যুদ্ধ, যার সঙ্গে এদের ছিল না বিন্দুমাত্র সম্পর্ক। যুদ্ধের এই দিকটি মনে হয় সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিক। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে ছোট হয়ে আসা আমাদের এই পৃথিবীতে দূরে কোথাও যুদ্ধ শুরু হলে এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা কারও পক্ষেই এখন আর সম্ভব নয়। ফলে আমাদের ঘরের আঙিনা থেকে অনেক দূরে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে আমাদেরও শঙ্কিত হতে হয় এ কারণে যে এর থেকে মুক্ত থেকে আনন্দের জীবন আমরা যে কাটাতে পারব, সে রকম মনে করে নেওয়ার কোনো রকম সুযোগ এখন একেবারেই নেই। এ কারণে আরও নেই যে মারণাস্ত্র গবেষণায় অভাবনীয় অগ্রগতি নিশ্চিত করে দিচ্ছে যে আগামীর বড় কোনো যুদ্ধে পরাজিত হবে একক কোনো দেশ বা ভূখণ্ড নয়, বরং মানবসভ্যতা। আর তাই অনেক দূরে কোথাও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে আমাদেরও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হয়, বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হয় যে যুদ্ধের অধিকার একক কোনো রাষ্ট্র কিংবা যুদ্ধবাজ সমরনায়কদের নিয়ে গড়ে ওঠা কোনো জোট কিংবা বলয়ের নেই এবং তা থাকতে পারে না। এখানেই মনে হয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। ইউক্রেন কিংবা তাইওয়ানকে ঘিরে দেখা দেওয়া উত্তেজনায় আমরা, বিশেষ করে আমাদের সংবাদমাধ্যম অজান্তেই হয়ে উঠছি যুদ্ধের একটি পক্ষ। ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করছি যে পক্ষের হয়ে কথা আমি বলছি, সেই পক্ষের অবস্থানকে যুক্তিসংগত প্রমাণ করতে। (ক্রমশ...)
লেখক জাপান প্রবাসী শিক্ষক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct