কবিগুরু রবীন্দ্রের সখী ছিল, ভালোবাসা ছিল। তাই তিনি সখীকে প্রশ্ন করিয়াছেন, সখি, ভালোবাসা কারে কয়! আমার সখী নাই, গুটিকয় সখা আছে। তাহাদেরই আমি প্রশ্ন করি, সখা, রগড়ানি কারে কয়। অতি সম্প্রতি অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত মহাশয় ‘রগড়ানি’ শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন তাঁহার বিজেপি ত্যাগের কারণ হিসাবে। এক প্রতাপশালী বিজেপি নেতার মুখে শিল্পীদের রগড়াইয়া দিবার কথা তিনি শুনিয়াছিলেন। এতদিন তিনি প্রতিবাদ করেন নাই, এখন করিতেছেন। চর্চিত এই বিষয় নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। আজ শেষ কিস্তি।
২০২১ সালের এপ্রিলে আনন্দবাজার পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে ঘোষ মহাশয় বলিয়াছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবী কারা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে বুদ্ধিজীবী রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। বুদ্ধিজীবী রাতারাতি তৈরি হয়ে যায় আবার গায়েবও হয়ে যায়। ’ঘোষ মহাশয়ের দল বাংলার বুদ্ধিজীবীদের ধরিতে যে চেষ্টা করেন নাই তাহা নহে। বিশেষ করিয়া বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের। তাঁহারা সহজ অঙ্কের হিসাব কষিয়াছিলেন। বামেরা তৃণমূলের বিরোধী, ২০১৯ এ বামের ভোট রামে গিয়াছিল, তাই বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা তাঁহাদের ফাঁদে পা দিবেন। কিন্তু আখেরে তাহাতে চিড়া ভিজে নাই। শত্রুর শত্রু বন্ধু হইল না কেন? তাই ঘোষ মহাশয় বিযম বিরক্ত হইলেন। মোদী-শাহ জুটিও কম চেষ্টা করেন নাই। একবার এক সমাবেশে হাজির ছিলেন কিছু বুদ্ধিজীবী। তাহার পর কে তাঁহাদের কান ভাঙাইল কে জানে, আর তাঁহারা আসিলেন না। যে গুটিকতক বসন্তের কোকিলের ন্যায় ভোটের আগে ভিড়িয়াছিলেন, কুপোকাৎ হইবার পরে তাঁহারা একে একে কাটিয়া পড়িতে লাগিলেন। ঘোষ মহাশয়ের দুঃখ পাইবার কোন কারণ নাই। বামপন্থী তত্ত্বপ্রণেতা কার্ল মার্কসের একটি কথা মনে পড়িতেছে। তিনি বুদ্ধিজীবীদের পেণ্ডুলামের সহিত তুলনা করিয়াছিলেন। তাঁহারা একবার এদিকে যান, পরক্ষণে ওদিকে যান। ম্যাক্সিম গোর্কি্ মহাশয়ও এইসব দোদুল্যমান বুদ্ধিজীবীদের খুব একচোট গালি দিয়াছিলেন। সিপিএম রাজ্যের ক্ষমতা লাভ করিয়াও বুদ্ধিজীবীদের আনুকূল্য লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহারা সকলে সিপিআইতে ছিলেন। এই যে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ শাঁওলি মিত্র চলিয়া গেলেন, তাঁহাকে এবং তাঁহার প্রবাদপ্রতিম পিতা শম্ভু মিত্রকে সিপিএমের প্রভূত গালি সহ্য করিতে হইয়াছিল। ‘পদাতিক কবি’ সুভাষ মুখার্জীকে একঘরে করিয়া রাখা হইয়াছিল। জ্যোতি বসু তো বলিতেন তিনি ‘কালচার-ফালচার’ বুঝেন না। বুদ্ধদেববাবু বহু চেষ্টা করিয়া ডান-বাম বুদ্ধিজীবীদের একত্র করিয়াছিলেন। বামপন্থীরা যাঁহাকে দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল বলিতেন, সেই বুদ্ধদেব বসু মহাশয়ও লিখিয়াছিলেন : ‘বুদ্ধিজীবী রুদ্ধঘরে সঙ্গীহীন / আত্মরতির অন্ধকারে কাটায় দিন।’ এ হেন দোদুল্যমান প্রাণীদিগকে সংযত করিবার জন্য ধমক-চমকের রগড়ানি অতীব প্রয়োজন। দিলীপ ঘোষ মহাশয় ভুল কিছু বলেন নাই। রগড়ানি কারে কয়, এবার বুঝিলে তো চাঁদু? তবে সেই সঙ্গে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ মহাশয়ের কথাটা মনে পড়িয়া যায়। তিনি বিজেপিকে বুদ্ধিজীবীবিরোধী দল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। গুহ মহাশয় বলিয়াছেন, ‘BJP is sadly the most anti-intellectual party . Unfortunately RSS were the most profoundly anti-intellectual people.’
(সমাপ্ত..)
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct