ফৈয়াজ আহমেদ : সারা পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে ৭০-৭৬ দিন সূর্য অস্ত যায় না! তাহলে কল্পনা করুন, সেখানে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের জন্য সময়ের হিসাব রাখা কতটা বিভ্রান্তিকর হবে, যখন সেখানকার স্থানীয়রাই টানা সত্তর দিনের বেশি সময়ের জন্য সূর্যাস্ত না পেয়ে বিভ্রান্ত থাকে। এই সূর্য অস্ত না যাওয়ার প্রাকৃতিক ঘটনাকে একটি সুন্দর নামে বর্ণনা করা হয়— ‘নিশীথ সূর্য’, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মিডনাইট সান’।
নিশীথ সূর্য কী?
একইসাথে ঘটা বিলম্বিত সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ে পৃথিবীর আকাশ লালচে হলুদ রঙে বর্ণিল হয়ে থাকে এই মধ্যরাতের সূর্যের দেশগুলোয়। নিশীথ সূর্য একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা গ্রীষ্মকালে অ্যান্টার্কটিক বৃত্তের দক্ষিণে, এবং আর্কটিক বৃত্তের উত্তরে ঘটে। মানে উত্তরাঞ্চলে এবং অ্যান্টার্কটিক বৃত্তের কাছাকাছি, দক্ষিণাঞ্চলে এই অবস্থা বিরাজ করে। এই ঘটনা বর্ণনা করতেই আর্কটিক বৃত্ত বা সার্কেলকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। নিরক্ষরেখার মতো, আর্কটিক বৃত্তও একটি কাল্পনিক রেখা— কোনো ভৌগোলিক বাস্তব সীমা নয়। পৃথিবী সূর্যের সাপেক্ষে কাত হয়ে থাকা একটি অক্ষের উপর ঘুরছে। গ্রীষ্মের মাসগুলোতে, উত্তর মেরু সূর্যের দিকে কোনাকুনি অবস্থায় আসে। এ কারণে আর্কটিক অক্ষাংশের উপরে গ্রীষ্মের সল্সটিস/অয়তান্ত-বিন্দুতে অবস্থানের (নিরক্ষরেখা থেকে সূর্যের দূরতম স্থানে অবস্থানকাল) সময় সূর্য দিনে অস্ত যায় না। সাধারণত ২১ জুনে সূর্যের এই উত্তরায়ন হয় সবচেয়ে বেশি। তাই আর্কটিক সার্কেলের উত্তরাংশে, উত্তর মেরুতে ২১ জুনের আগে ও পরে মিলিয়ে বছরের ছয় মাস পর্যন্ত নিত্য রোদের সময় বিরাজ করে। যদিও বছরের কিছু অংশে এর বিপরীতটাই ঘটে। যেমন, আর্কটিক সার্কেলের উপরে, শীতের সল্সটিসে, দিনের বেলা সূর্য কখনোই ওঠে না (সাধারণত ২১ ডিসেম্বরের কাছাকাছি)। মানে সেখানে বছরের অর্ধেক সময় ধরে শীতকালে সবসময় রাত বিরাজ করে। এই ঘটনাটি ঘটে কারণ পৃথিবী তার অক্ষের উপর প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে থাকে। তাই মেরু অঞ্চলের জন্য (উত্তর ও দক্ষিণ মেরু উভয় দিকে) সূর্য বছরে একবারই ওঠে এবং অস্ত যায়। আর্কটিক সার্কেলের সীমানার ভেতরে বা তার সীমানা ঘিরে এমন বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে। এই স্থানগুলোকেই ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ বলা হয়ে থাকে, কারণ সেসব স্থানে গ্রীষ্মকালে প্রায়ই মধ্যরাতের পর সূর্য দেখা যায়। এসব অঞ্চলের গ্রীষ্মকালে সূর্য দিগন্তরেখার নিচে নামে না এ সময়টাতে প্রায়।অপরদিকে, বছরে অ্যান্টার্কটিকাতে মাত্র এক হাজারের মতো লোক কাজ করে, তাই খুব কম লোকই সেখানে এমন ঘটনাগুলো অবলোকন করতে পারে। যারা এই অঞ্চলে বাস করে তারা দীর্ঘ সময়ের জন্য অবিরাম সূর্যের আলো কিংবা অবিরাম অন্ধকারে অবশেষে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যদিও নতুনদের বা দর্শনার্থীদের জন্য প্রায়ই এই প্রেক্ষাপটে মানিয়ে নেওয়া কিছুটা কঠিন ঠেকতে পারে, এবং ঘুমানোর ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে যখন সূর্য সারারাত ধরে জ্বলজ্বল করতে থাকে। এবার পৃথিবীর যেসকল স্থানে এমন ঘটনা ঘটে সেসকল স্থান নিয়ে কিছু জেনে নেওয়া যাক।
নরওয়ে
সৌন্দর্য ও নান্দনিক দৃশ্যের জন্য বিশ্বে খ্যাতি রয়েছে নরওয়ের। এটি বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশও বটে। শুধু তা-ই নয়, এখানকার মানুষ স্বাস্থ্য সম্পর্কেও অনেক সচেতন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে নরওয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দেশটি আর্কটিক সার্কেলের মধ্যে অবস্থিত। আর্কটিক সার্কেলে অবস্থিত নরওয়েকে মধ্যরাতের সূর্যের ভূমি বলা হয়, যেখানে মে থেকে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত সূর্য আসলে অস্ত যায় না। এর মানে প্রায় ৭৬ দিনের জন্য সূর্য একবারও অস্ত যায় না।
স্ভালবার্ড (Svalbard), নরওয়ে
ইউরোপের উত্তরাঞ্চলীয় জনবহুল অঞ্চল। এটি মেরু ভালুকের অঞ্চল যা ৭৪°-৮২° উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত। স্ভালবার্ড হলো নরওয়ের সেই জায়গা, যেখানে নিশীথ সূর্য সবচেয়ে বেশি সময় ধরে অবস্থান করে। এখানে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত চার মাস সূর্য একটানা জ্বলজ্বল করে।
হ্যামারফেস্ট (Hammerfest), নরওয়ে
হ্যামারফেস্ট বিশ্বের উত্তরাঞ্চলের শহরগুলোর মধ্যে একটি। প্রায় আট হাজার জনবসতির এই শহর উত্তর নরওয়ের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি। স্ট্রুভ জিওডেটিক আর্কের অংশ হওয়ায় এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের এক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এই শহরে সূর্য মধ্যরাত ১২:৪৩ এর দিকে অস্ত যায় এবং মাত্র ৪০ মিনিটের ব্যবধানে আবার ওঠে। লোফোটেন এবং ভেস্টারলেন দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রের কাছাকাছি বসবাসকারী লোকদের মুগ্ধতা যেন ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলগুলো জুড়ে। এই বিশেষ প্রাকৃতিক ঘটনা নরওয়েজিয়ান শিল্পী এবং লেখকদের উপর একটি স্থায়ী ছাপ ফেলেছে। নুট হামসুন নামে এক লেখকের ‘প্যান’ (১৮৯৪) গ্রন্থ থেকে একটি অংশ তুলে ধরা হলো যেখানে এই ঘটনার রূপের খানিকটা বর্ণনা করা হয়েছে, রাত আবার ঘনিয়ে আসছিল; তখনই সূর্য সমুদ্রে একটুখানি ডুব দিল এবং আবার উঠল লাল হয়ে, সতেজ রূপে, যেন জল পান করতে নেমেছিল। সেই অনিন্দ্যসুন্দর রাতগুলো আমার ভেতর যে আলোড়ন জাগিয়েছিল, সেই অনুভূতি কাউকে বলে বিশ্বাস করানো অসাধ্যকর।
নুনাভুত (Nunavut), কানাডা
নুনাভুত এমন এক শহর যেখানে মাত্র ৩,০০০-এর কিছু বেশি লোক বাস করে। এটি কানাডার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আর্কটিক সার্কেলের দুই ডিগ্রি উপরে অবস্থিত। এই স্থানটি প্রায় দুই মাস ২৪/৭ সূর্যের আলোর নিচে থাকে, যেখানে শীতকালে এই জায়গাতে প্রায় ৩০ দিন টানা অন্ধকার বিরাজ করে।
ইউকন (Yukon), কানাডা
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশের একটি শহর যা এক বছরে দীর্ঘ সময় ধরে বরফে ঢাকা থাকে। এখানকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গ্রীষ্মের দিনগুলোতে সূর্য একটানা ৫০ দিন ধরে জ্বলজ্বল করে। অনিন্দ্যসুন্দর আকাশের দৃশ্য ধারণকারী, এবং অসীম গ্রীষ্মের আলো মাখা একটি মধ্যরাতের সূর্যের অঞ্চল হিসাবে ইউকন বেশ পরিচিত।
ব্যারো (Barrow), আলাস্কা
মে মাসের শেষ থেকে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত সূর্য এখানে অস্ত যায় না। পরবর্তীতে নভেম্বরের শুরু থেকে টানা এক মাসের জন্য যেন এর ক্ষতিপূরণ চলে! তখন সূর্যের সাথে দেখা হয় না এ শহরের, এবং একে আখ্যায়িত করা হয় ‘মেরু রাত’ হিসেবে। শীতের ঠাণ্ডায় জমাট মাসে দেশ অন্ধকারে ডুবে থাকে। তুষারাবৃত পাহাড়, এবং মন্ত্রমুগ্ধ হিমবাহের জন্য বিখ্যাত এই স্থানটি গ্রীষ্ম বা শীতকাল উভয় সময়েই পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।
আইসল্যান্ড
গ্রেট ব্রিটেনের পরে ইউরোপের সবচেয়ে বড় দ্বীপ আইসল্যান্ড। দেশটি আরেকটি কারণেও বেশ পরিচিত- এখানে কোনো মশা নেই! গ্রীষ্মকালে আইসল্যান্ডে রাতের আকাশ থাকে ফর্সা ও পরিষ্কার। এখানে জুন মাসে সূর্য অস্ত যায় না। মধ্যরাতের সূর্যকে তার পূর্ণ রূপ ও গৌরবে দেখতে পাওয়া যায় আর্কটিক সার্কেলের আকুরেয়ারি এবং গ্রিমসে দ্বীপে।
কানাআক (Qaanaaq), গ্রীনল্যান্ড
শহরটি গ্রিনল্যান্ডের একেবারে উত্তরে অবস্থিত। এর বাসিন্দা মোটে ৬৫০ জনেরও কম। এখানে নিশীথ সূর্যের সময় আড়াই মাস স্থায়ী হয়। সেই সময় মানুষকে ঘুমানোর জন্য কালো পর্দা টানিয়ে ঘুমাতে হয়। এখানে শীতের দিনগুলো হয় দীর্ঘ এবং ঠাণ্ডা, আর এর রাতগুলো হয় এত সুন্দর যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ফিনল্যান্ড
হাজার হাজার হ্রদ এবং দ্বীপের দেশ, ফিনল্যান্ডের অধিকাংশ অঞ্চলকেই গ্রীষ্মকালে প্রায় টানা ৭৩ দিনের জন্য সূর্যের আলো দেখতে হয়। আবার শীতকালে সেই অঞ্চলগুলোয় সূর্যের আলো দেখা যায় না। সেখানকার মানুষ কেন গ্রীষ্মে কম ঘুমায় এবং শীতকালে বেশি ঘুমায়, এর একটা কারণ এই আবহাওয়া-প্রকৃতি। এখানে দেখা মেলে নর্দার্ন লাইটস এবং কাচের ইগলুর।
সুইডেন
মে মাসের প্রথম দিক থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত, সুইডেনে মধ্যরাতের দিকে সূর্য ডোবে, এবং ভোর চারটার দিকে সূর্য উঠতে দেখা যায়। এখানে স্থির সূর্যতাপের সময় বছরের ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া
১০ লক্ষাধিক জনসংখ্যার শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্বের একদম উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। এটি এত উঁচু অক্ষাংশে যে, দেড় মাস ধরে সূর্য দিগন্তের নীচে নামতেই পারে না আকাশকে অন্ধকার করতে। সেই দীর্ঘসময় পিটার্সবার্গের আকাশ থাকে রৌদ্র ঝলমলে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct