কবিগুরু রবীন্দ্রের সখী ছিল, ভালোবাসা ছিল। তাই তিনি সখীকে প্রশ্ন করিয়াছেন, সখি, ভালোবাসা কারে কয়! আমার সখী নাই, গুটিকয় সখা আছে। তাহাদেরই আমি প্রশ্ন করি, সখা, রগড়ানি কারে কয়। অতি সম্প্রতি অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত মহাশয় ‘রগড়ানি’ শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন তাঁহার বিজেপি ত্যাগের কারণ হিসাবে। এক প্রতাপশালী বিজেপি নেতার মুখে শিল্পীদের রগড়াইয়া দিবার কথা তিনি শুনিয়াছিলেন। এতদিন তিনি প্রতিবাদ করেন নাই, এখন করিতেছেন। চর্চিত এই বিষয় নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। আজ প্রথম কিস্তি।
কবিগুরু রবীন্দ্রের সখী ছিল,ভালোবাসা ছিল। তাই তিনি সখীকে প্রশ্ন করিয়াছেন, সখি, ভালোবাসা কারে কয়! আমার সখী নাই, গুটিকয় সখা আছে। তাহাদেরই আমি প্রশ্ন করি, সখা, রগড়ানি কারে কয়। অতি সম্প্রতি অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত মহাশয় ‘রগড়ানি’ শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন তাঁহার বিজেপি ত্যাগের কারণ হিসাবে। এক প্রতাপশালী বিজেপি নেতার মুখে শিল্পীদের রগড়াইয়া দিবার কথা তিনি শুনিয়াছিলেন। অভিনয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এতদিন তিনি প্রতিবাদ করেন নাই, এখন করিতেছেন। প্রতাপশালী সেই নেতা পূর্বে বঙ্গ বিজেপির সভাপতি ছিলেন। এক্ষণে তিনি সে পদে নাই। তিনি এখন সর্বভারতীয় সহ সভাপতি। ইহা প্রমোশন না ডিমোশন তাহা আমাদের গোচরে নাই। তবে পুর্ববৎ সেই মহাশয় মুখর আছেন। প্রাতঃস্মরণীয় সেই দিলীপ ঘোষ মহাশয় গত বছর এপ্রিল মাসে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের গানের ভিডিও প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন যে এইসব শিল্পীরা রাজনীতি করিতে আসিলে তিনি রগড়াইয়া দিবেন। ‘মুখে ঝামা ঘষিয়া দিবেন’ বলিলে শিল্পীরা বোধকরি এতটা ক্ষুব্ধ হইতেন না। কিন্তু ঘোষ মহাশয় দেশজ ভাষায় কথা কহিতে ভালোবাসেন। হয়তো মনে মনে তিনি সিপিএমের নেতা প্রয়াত হরেকৃষ্ণ কোনার মহাশয় কিংবা তাঁহার ভ্রাতা বিনয় কোনার মহাশয়কে অনুকরণ করিবার চেষ্টা করেন। ইঁহারাও দেশজ ভাষায় দেশজ গালি দিতে পারিতেন।
গ্রিক দাশর্নিক প্লেটো ঘোষ মহাশয়ের দীক্ষাগুরু কি না জানি না। তবে প্লেটোর মতো তিনি শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীর বিরোধী। শিল্পীরা ঈশ্বরের অনুকরণ করেন বলিয়া তাঁহাদের প্রতি প্লেটোর বিরাগ ছিল। ‘রিপাবলিক’ হইতে তিনি শিল্পীদের তাড়াইতে চাহিয়াছিলেন। ঈশ্বরতুল্য মোদী-শাহকে শিল্পী- বুদ্ধিজীবীদের অপমান-অসম্মান করিতে বাধে নাই বলিয়া তাঁহাদের প্রতি ঘোষমহাশয়ের বিরাগ। তাই তিনি মাঝে মাঝে তাঁহাদের রগড়াইয়া দেন। তাঁহার রগড়ানি সহ্য করিতে না পারিয়া বাবুল সুপ্রিয়, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, পায়েল সরকার বিজেপি ছাড়িয়া দিয়াছেন। এ সকল কারণে ঘোষ মহাশয়কে তাঁহার উচ্চতর নেতারা রগড়াইবেন কি না, তাহা বলিতে পারি না। তবে বঙ্গ বিজেপির সভাপতির পদ কাড়িয়া লইয়াও যখন উচ্চতর নেতারা ঘোষ মহাশয়ের মুখে কুলুপ আঁটিতে পারেন নাই, তখন ভবিষ্যতেও যে পারিবেন, তাহা মনে হয় না। দেবভাষায় প্রবাদ আছে অঙ্গারকে শতবার ধুইলেও তাহার মলিনতা মুছা যায় না।বুদ্ধিজীবীদের রগড়াইবার ব্যাপারে ঘোষ মহাশয়ের একটা ধারাবাহিকতা আছে। ২০১৭ সালে তিনি বুদ্ধিজীবীদের ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন। অর্থাৎ ইঁহাদিগের কোন ব্যক্তিত্ব নাই, নিজস্ব কোন মত নাই, কর্তার ইচ্ছায় তাঁহারা পরিচালিত হন। যদি মেরুদণ্ড থাকিত তাহা হইলে তাঁহারা অন্য কোন দলকে সমর্থন না করিয়া সমর্থন করিতেন বিজেপিকে। ২০১৯ সালের জুন মাসে ঘোষ মহাশয় আবার কামান দাগিলেন। জনসংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ৬৬ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি কলিকাতার বুদ্ধিজীবীদের ‘ভীতু ও সুযোগসন্ধানী’ বলিলেন। মেরুদণ্ডহীনরাই ভীতু ও সুযোগসন্ধানী হন।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বুদ্ধিজীবীরা সিএএ বিরোধিতায় মুখর হইলে ঘোষ মহাশয় খেপিয়া গেলেন। স্পর্ধা তো কম নয় ! নরেন্দ্র-জগদীশ্বর বহু ভাবিয়া- চিন্তিয়া যাহা প্রবর্তন করিতে চলিয়াছেন, তাহাতে বাগড়া দিতে চান বুদ্ধিজীবীরা! তাঁহারা ‘কাগজ দেখাব না’ বলিয়া তারস্বরে চিল্লাইতেছেন কেন ! ঘোষ মহাশয় বুদ্ধিজীবীদের ‘পরজীবী ও নেমকহারাম’ বলিয়া গালি পাড়িলেন। বিজ্ঞানীদেরও ছাড়িলেন না তিনি। বলিলেন, ‘বিজ্ঞানে কি অবদান আছে তাঁহাদের?’ বিজ্ঞানীদের গালি পাড়িবার অন্য কারণ আছে। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে আধুনিক বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারই আছে – সংঘ পরিবারের এই তত্ত্বকে তাঁহারা নতমস্তকে স্বীকার করিয়া লন নাই। অবশ্য শুধু বিজ্ঞানী নন, ঘোষ মহাশয় ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ কাহাকেও ছাড়িয়া দেন নাই। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে ঋদ্ধি সেন ও ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় একটি গানের ভিডিও তৈরি করেন। ইহার নাম ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’। ইহাতে অভিনয় করেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কৌশিক সেন, অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যা্য় প্রমুখেরা। ঘোষ মহাশয় তাঁহাদের বলিলেন, ‘নাচ-গান-অভিনয় করুন যতখুশি, রাজনীতি করিতে আসিলে রগড়াইয়া দিব’। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা কেবল মেরুদণ্ডহীন বা ভীতু নন, তাঁহারা দেশদ্রোহী। বিএসএফ প্রসঙ্গে বিরূপ মন্তব্য করায় ২০২১ সালের নভেম্বরে ঘোষ মহাশয় বুদ্ধিজীবীদের ‘দেশদ্রোহী’ বলিলেন। বিজেপির মতো দেশপ্রেমিক আর কে আছে? আমার মতো দেশপ্রেমিক নাই গো নাই। বিএস এফের এলাকা বাড়াইবার সিদ্ধান্ত একটি দেশপ্রেমিক সিদ্ধান্ত। মোদীবাবু ও শা্হবাবু তাহাতে শিলমোহর দিয়াছেন। তাহার বিরোধিতা? (ক্রমশ..)
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct