পণপ্রথা
মহঃ মনিরুজ্জামান
________________
আজ পোস্টমার্টাম রূমে এক জলন্ত বিভীষিকাময় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এক অশরীরিয় শরীর দেখে বিশেষ ভাবে আতকে উঠলাম। ড. বিশেষ ভাবে নিরক্ষন করে, রিপোর্ট দিয়ে বললেন ওনাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বিকট গন্ধে টেকার জো নেই। তাই একটু বাইরে ঘুরে আসতেই দেখি, পোস্টমার্টাম রূমের বাইরে দাড়িয়ে থাকা এক মহিলা গণেশ নাম ধরে সজোরে চিৎকার করে করে বলছে, “ তুমি আমাদের সব কিছু নিয়ে নাও... কিন্তু তার পরিবর্তে আমাদের সুরমা কে ফিরিয়ে দাও..... ফিরিয়ে দাও”।। ব্যপারটা বেশ জটিল বলেই মনে হল। ব্যপারটা জানার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোককে জিগ্গেস করতে বলল, “ মশাই জানেন না, গত মাসে শশুর বাড়ির লোক এক লক্ষ টাকা চেয়েছিল.... কিন্তু দিতে না পারায় প্রথম দিকে মারধর তারপর অবশেষে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মেরেই ফেলল। “ ...
তারপর কিছুক্ষন আটকে রাখা কার্বন ডাই অক্সাইড পূর্ন নিশ্বাস সজোরে ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চল্লাম আর মনে মনে ভাবলাম সুরমার মতো কতো যে, এই ভাবে পরলোক গমন করছে তা শুধু পরের লোকই জানে।হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ভাবছেন সমাজের এক অন্যতম কুপ্রথা -’পণপ্রথা’ কথাই বলছি যা সুরমার মতো কতই না শত শত সাধারণ পরিবারের নিস্পাপ মেয়েদেরকে বলীর পাঠা করে। কে জানে। ভাবলেই যেন শরীর হিম হয়ে আসে।। আসলেই পণ কী? কীভাবে এল এই প্রথা? এই প্রথা সমাজে কীভাবে প্রভাব ফেলে??... এই প্রথার শেষ পরিনতি কী? এই প্রথা না হলে কতই না মেয়ে বেচে যেত।প্রশ্ন গুলি শুধু মানুষের মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। ‘পণ’ অর্থাৎ যৌতুক ( ইয়াতুকা) ইয়াতুকা কথাটির অর্থ হল একটি মেয়ের বিবাহের সময় তাঁর বাবা, মা বা অন্যান্য লোকজন দ্বারা ভেট বা উপহার দেওয়া সামগ্রী।
পণ (Dowry) কী?
একটি সাধারণ পরিবারের বিবাহের সময় যদি ছেলে পক্ষ নিজেদের স্বার্থে ও কল্যাণে মেয়ে পক্ষের কাছথেকে কিছু উপহার, উপঢৌকন, টাকা, সম্পত্তি, ইত্যাদি জোরপূর্বক চেয়ে বসে - সেটাই পণ বা যৌতুক।
আর বর্তমান সমাজে এটা একটা সঙস্কার হয়ে উঠেছে। এই সঙস্কার বা প্রথাই হল পণ প্রথা।।
কীভাবে এল এই প্রথা?
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে উঠে আসে, প্রাচীন কালে ব্যবলনীয় সভ্যতা (1800 BC) , গ্রীক সম্রাজ্য (500 BC), রোমান সাম্রাজ্যে পণ প্রথার বিশেষ বিস্তর ছিল।
কিন্তু ভারতে একাদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত পণ প্রথা নেই বললেই চলে। ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার কয়েক বছর পর 1793 সালে লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে এসে ভারতের ভূমি প্রথায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন। তিনিই প্রথম শুরু করেন জমিনদার প্রথা ও বঙশগত ভূমি ভাগের কথা। অর্থাৎ কোন জমিদার মৃত্যু পরবর্তী উত্তর তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তাঁর পুত্র সন্তানরা পাবেন কিন্তু পাবেনা কন্যা সন্তান বর্গ।। ফলে, কন্যার বিবাহের পর তার স্বামী বা স্বামীর পরিবার তার উপর বিশেষ ভাবে চাপ সৃষ্টি করে পিতার সম্পত্তির অল্পস্বল্প ভাগিদার হতে থাকে। এই লোভ আসতে আসতে একটা প্রথায় পরিনত হয়। এভাবেই পণ প্রথার উদ্ভব ঘটে।।
এই প্রথা সমাজে কী প্রভাব ফেলে???
এই প্রথা সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে -
১• এই প্রথা থেকে বাচতে বা যাতে তাদের কন্যা সন্তানদের জমির পরিমাণ না দিতে হয়। সেই জন্য মহিলা দের উপর বিশেষ মানসিক ও শারীরিকনির্যাতন করা হয় কন্যা সন্তান না নেওয়ার জন্য।
২• ফলে sex ratio ক্রমশ বাড়তেই থাকে। পুত্র: কন্যা এটার অনুপাতের বিঘ্ন ঘটে। ভারতে কন্যা সন্তানের তুলনায় পুত্র সন্তান 60 মিলিয়ন অধিক, তার অন্যতম কারণ এই পণ প্রথা।
৩• এই পণ প্রথার জন্য বর্তমানে বিবাহ ব্যবস্থা টা অনেকটা ব্যবসায় পরিনত হয়েছে। অধিক সম্পত্তির মালিকানার কন্যা সন্তানের বিবাহ হতে সময় না লাগলেও গরীবের সন্তানের যথেষ্ট কষ্ট হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি কী?
বর্তমানে বহু মহিলা এই জঘন্য প্রথার স্বিকার হয়ে প্রান হারায়। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতি ৬০ মিনিটে একজন ভারতীয় মহিলা এই প্রথার স্বিকার হয়ে মারা যায়।।
আইন গত ব্যবস্থা
পণ প্রথা যেমন ব্যক্তি মহলে আলোচ্য বিষয় তেমনি সরকার মহলেও এর বিস্তর প্রভাব রয়েছে। ১৯৬১ সালের ১ লা জুলাই প্রথম Dowry prohibition act চালু করা হয়। এই এ্যক্ট এর IPC ( indian penal code) বিভিন্ন ধারা রয়েছে-
1. IPC - sec 498/A- অর্থাৎ ধারা ৪৯৮/ এ অনুযায়ী জোর পূর্বক পণ নেওয়ার যাবৎজীবন শ্রসম কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হবে।
2. IPC - sec 304/B - অর্থাৎ ধারা ৩০৪/ বি অনুযায়ী ও যাবৎকালের কারাদণ্ড দেওয়া হবে।
3. IPC - sec 406 - অর্থাৎ এই ধারা অনুযায়ী পণ নিলে তিন বছর জেল ও পর্যাপ্ত পরিমাণ জরিমানা নেওয়া হয়।।
অভিযোগ কোথায় জানাবেন :
পাত্রপক্ষ পণ দাবি করলে, যাঁর কাছে দাবি করেছে, তিনি নিজে বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় থানায় এফআইআর করতে পারেন। আর পুলিশ অভিযোগ না নিলে ওই এলাকার মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট বা ওই এলাকার প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ জানানো যায়। রাজ্য সরকারও এই আইন প্রয়োগের জন্য বিশেষ অফিসার নিয়োগ করতে পারে। জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিকের কাছেও অভিযোগ জানানো যায়। মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিজে উদ্যোগ নিয়ে অথবা পুলিশি রিপোর্টের ভিত্তিতে অভিযোগের বিচার করতে পারেন। এ ছাড়াও যাঁর কাছে বা যাঁদের কাছে পণ চাওয়া হয়েছে তিনি বা তাঁরা যে কোনও স্বীকৃত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে নালিশ জানাতে পারেন। এই অভিযোগ জানানোর কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।
স্ত্রী-ধন উত্তরাধিকারীর প্রাপ্যভূমিকা:
অনেক সময় দেখা যায় পণ নেওয়ার পরও মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে নিগৃহিতা হন। তাঁদের স্ত্রী ধন কেড়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের নিজস্ব গহনাপত্র শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেড়ে নেয়। এই পরিস্থিতিতে আইনি সাহায্য নেওয়ার আগে সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে স্ত্রী ধনের উপর শ্বশুরবাড়ির ন্যায্যত কোনও অধিকার নেই। পণ জনিত মৃত্যু হলে শুধু জিডি বা জেনারেল ডায়েরি করলে হবে না রীতিমতো ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট বা এফআইআর দাখিল করতে হবে। সেই এফআইআরের মাধ্যমে পুলিশ মামলা শুরু করতে বাধ্য। দায়রা আদালতে অথবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে এই মালার বিচার হবে। এই অপরাধের বিচার হবে জামিন অযোগ্য ধারায়। শাস্তিও জামিন অযোগ্য। কমপক্ষে ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সুযোগ আইনে রয়ে গিয়েছে। আর সেই সঙ্গে পণ দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত থাকলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। বিয়ের এক বছর আগেও কোনও রকম পণ দেওয়া হলে, তা স্ত্রীরই প্রাপ্য। আবার বিয়ের সময় বা এক বছর পরে দেওয়া হলেও একই নিয়ম। নাবালিকা বধুর ১৮ বছর বয়স হলে, যৌতুক হিসেবে পাওয়া সমস্ত সামগ্রী তাকে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পণের টাকা বা সামগ্রী স্ত্রী-ধন হিসাবে বধূ বা তার উত্তরাধিকারীরই প্রাপ্য। এই আইনি পরিষেবা কেন্দ্রগুলি সব সময় নিখরচায় নির্যাতিতা মহিলাদের অথবা মানসিক ভাবে অত্যাচারিতা মহিলাদের পরিষেবা প্রদান করে থাকে। অসহায় মহিলাদের হয়ে মামলা চালানোর যাবতীয় খরচ পরিষেবা কর্তৃপক্ষই বহন করে থাকে। এ পর্যন্ত বহু মহিলা পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তিলাভে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের করনীয় কী?
বিবাহযোগ্য মহিলারা পণপ্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন। পণপ্রথা রোধ করার বিরুদ্ধে তাঁরা রাস্তায় নামতে পারেন, আবার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে পণ না দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ (স্টেট লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি ওয়েস্ট বেঙ্গল) বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে শহরে বিভিন্ন সময়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করে থাকে। সেই সব আইনি সচেতনতা শিবিরে দেখা গিয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী থেকে আইন নিয়ে পাশ করা স্নাতক মহিলারা পর্যন্ত অভূতপূর্ব সাড়া দিচ্ছেন। বিয়ের দিনেও অনেক পাত্রী পাত্রপক্ষ পণ নিচ্ছে জেনে বিয়ে আটকে দিচ্ছে। প্রতিবাদ করাটাই বড় কাজ। আমরা সামাজিক জীব। সমাজ বদ্ধ ভাবে থাকা আমাদের স্বভাব। তাই একসাথে সবাই মিলে এই দৌত্যকার প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সমাজের প্রতিটি মানুষকে সজাগ করে তোলাই, একমাত্র উপায় এই প্রথার উচ্ছেদ ঘটানো।। আসুন সবাই মিলে বলি,
“ পণ হটাও
সমাজ বাঁচাও “
অথবা, “পণ নেবো না,
পণ দেবো না”
সমাজে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান
এই পন প্রথাকে রুখতে হলে নারীশক্তি
কে উচ্চ শিক্ষিত হতেই হবে
সমাজ প্রেমীদের সতর্ক হতে হবে।।
সূত্র : পণপ্রথা নিষিদ্ধকরণ আইন, মলয় ঘোষ, যোজনা, অক্টোবর ২০১৪
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct