ফৈয়াজ আহমেদ : ২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনাভাইরাস ভয়াবহ থাবা বসিয়ে মহামারির আকার ধারণ করলে থমকে যায় পুরো পৃথিবী। সারা বিশ্বই পরিচিত হয় লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন নামক নতুন কিছু শব্দের সাথে, যা পূর্বে শুধুমাত্র মেডিকেল টার্মিনোলজিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।বাণিজ্য-বিনোদন-ক্রীড়া জগতসহ জনজীবনের সর্বত্রই দেখা দেয় এক স্থবিরতা। তবে লকডাউনের এই সময়ে মানুষ গৃহবন্দিত্বকে বরণ করে নিলেও তথ্য-প্রযুক্তির সয়লাবের যুগে থেমে থাকেনি যোগাযোগব্যবস্থা। তাই, সেসময় অনলাইন কমিউনিকেশন হয়ে ওঠে যোগাযোগের এক মুখ্য হাতিয়ার। ২০২০ সালের মার্চে জুম অ্যাপের ডাউনলোড বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭২৮ শতাংশ এবং তাদের স্টক প্রাইজ ঊর্ধ্বগামী হয়েছিল ৩০০ শতাংশেরও বেশি। তখন জুমের মার্কেট ভ্যালুয়েশন আমেরিকান মাল্টি-ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি AMD এবং Unilever-কেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেও যেখানে জুম অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১০ মিলিয়ন, তা এখন ঠেকেছে ৫০০ মিলিয়নের ঘরে, এবং দিন দিন তা দুর্বার গতিতে বেড়েই চলেছে। কীভাবে জায়ান্ট ইন্ডাস্ট্রিদের সাথে দুরন্ত প্রতিযোগিতা দিয়ে জুম আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছে?
জুম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এরিক ইউয়ানের হাত ধরে। ১৯৭০ সালে চীনে জন্মগ্রহণ করা এই ব্যক্তি ফলিত গণিত এবং মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত। বিল গেটসকে দেখে যারপরনাই অনুপ্রাণিত হতেন ইউয়ান। সেই স্বপ্ন বুকে লালন করে নিজে কিছু করার স্বপ্ন দেখছিলেন। ১৯৯৫ সালে জাপানে বিল গেটসের এক ভাষণ শুনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তিনি ইংরেজি জানতে অল্প। এজন্য টানা নয়বার তার যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিল হবার পর অবশেষে ‘৯০-এর দশকে তিনি সিলিকন ভ্যালিতে আসতে সক্ষম হন। শুরুতে তিনি ‘WebEx Communications’ নামে একটি কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন, যারা কাজ করত মূলত ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম নিয়ে। ইউয়ান দায়িত্বে থাকাকালীন WebEx বেশ সফলতা অর্জন করে। তখন প্রতিবছর প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয়ে সক্ষম হয় তারা। ২০০৭ সালে Sisco Systems ৩.২ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় WebEx-কে। সেসময় WebEx দারুণ জনপ্রিয়তা কুড়ালেও বেশ কিছু ত্রুটি বিদ্যমান ছিল তাদের সফটওয়্যারে। তাদের কানেক্টিভিটি ছিল দুর্বল। অডিও এবং ভিডিও ল্যাগ করতো মাঝে মাঝে, এমনকি ইন্সটলেশন প্রক্রিয়াও ছিল বেশ ঝামেলার। তবুও বাজারে ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপের ততটা প্রতিযোগিতা না থাকায় WebEx তখন তাদের ব্যবসা ভালোমতোই চালিয়ে যেতে পারছিল। ব্যবহারকারীরা যে WebEx নিয়ে যথার্থই অসন্তুষ্ট, তা ইউয়ান আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি একটি সোজাসাপ্টা ও ত্রুটিমুক্ত ভিডিও কলিং সার্ভিস তৈরি করার কথা চিন্তা করলেন, যা দিয়ে ব্যবহারকারীরাও সন্তুষ্ট থাকবে, সাথে তাদের ব্যবসার কাটতিও থাকবে ভালো। Cisco-কে তিনি এই বিষয়ে প্রস্তাবনা পাঠালে তারা বিষয়টাতে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। কিন্তু নাছোড়বান্দা ইউয়ানও দমে যাওয়ার পাত্র নন। WebEx থেকে চল্লিশজন প্রকৌশলীকে নিয়ে এসে নিজেই নতুন একটি ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
২০১১ সালে ইউয়ান বিনিয়োগকারীদের থেকে ৩ মিলিয়ন ডলার নিয়ে জুম প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে Skype-এর মতো অন্যান্য ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপগুলো শুরুতেই অডিও কল দিয়ে কাস্টমারদের তাদের সার্ভিস দিয়ে আসছিল, সেখানে জুম প্রথমদিকে নজর দেয় ভিডিও কল ফিচারের দিকে। কারণ, ইউয়ানের আসল লক্ষ্য ছিল একটি নির্ভরযোগ্য ও সুবিধাজনক ভিডিও কলিং অ্যাপ তৈরি করা। কোম্পানি থেকে জুমের একটি বেটা ভার্সন লঞ্চ করা হয়, এবং গ্রাহকদের মাঝে এই সংস্করণটি বেশ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। খুঁটিনাটি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে জুম অ্যাপটি মার্কেটে উন্মুক্ত করা হয়। শুরু থেকেই ছক্কা হাঁকিয়েছিল জুম। সে বছরের মে মাসে তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। পরের কয়েক বছর বিনিয়োগকারীরা জুমের পেছনে কাড়ি কাড়ি অর্থ ঢালতে আগ্রহ প্রকাশ করলে সেটি মার্কেটে একটি পাকাপোক্ত জায়গা নিতে সক্ষম হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জুমের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ মিলিয়নে পৌঁছায়। সেই বছর জুমের রাজস্ব ছিল ৩৩০.৫ মিলিয়ন ডলার। একটি স্টার্ট-আপ কোম্পানি হিসেবে খুব অল্প সময়ে বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হয় তারা। তবে ২০২০ সাল ছিল জুমের গোল্ডেন পিরিয়ড। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করা হলে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা পায় জুম। গত বছরের মে মাসে তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। বছরের প্রথম কোয়ার্টারে জুমের রাজস্ব ১৬৯ শতাংশ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩২৮.২ মিলিয়ন ডলারে। Companies Market Cap এর তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে জুম এর মূলধন ৫২.৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্লেষকদের ৫০ কোটি ৫ লাখ ডলার মুনাফার প্রত্যাশাকে পেছনে ফেলে ২০২০ সালের ৩১ জুলাইয়ের হিসাবে গত তিন মাসে জুম মুনাফা করে ৬৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলার, যা পূর্বের চেয়ে ৩৫৫ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ এর মাঝামাঝি সময়ে মুনাফা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। পাল্লা দিয়ে গ্রাহকসংখ্যা বেড়েছিল ৪৫৮ শতাংশ।
বাজারে বর্তমানে যেসব ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ আছে, সেসবের মধ্যে জুম সবচেয়ে বেশি ইউজার ফ্রেন্ডলি। Chrome, Safari, Firefox-সহ প্রায় সবধরনের ব্রাউজারের সাথে জুম স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেকে সংযুক্ত করে নিতে পারে। আবার অ্যাপ ডাউনলোড না করেও জুমের সাহায্যে ক্লাউড মিটিং করা সম্ভব। সেজন্য মিটিং রুমের হোস্টের দেয়া লিংকে ক্লিক করলেই সরাসরি জুম মিটিংয়ের সাথে কানেক্ট করে দেয়া হবে। এতে করে জুম ব্যবহারের জন্য আলাদাভাবে অ্যাপ ডাউনলোড বা ইন্সটল করার বাধ্যবাধকতা থাকে না। যা ব্যবহারকারীদেরকে অনেকটা সময় নষ্ট করা থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া জুমের ইন্টারফেসটি বেশ চমকপ্রদ, গোছানো, এবং সহজ সকল ফিচার দিয়ে সাজানো। গ্যালারি ভিউ মোডের সাহায্যে একই স্ক্রিনে একাধিক ইউজার ভিউ অপশন দেয় জুম। যার ফলে জুমের কনফারেন্স কল বাকিসব ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ থেকে বেশ সুবিধাজনক এবং আকর্ষণীয়। জুমের সফলতার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এটি বিনামূল্যে অন্যান্য কোম্পানি থেকে অধিক সেবা প্রদানের কারণে জনমনে ভরসা কুড়িয়ে নিয়েছে। যেখানে Skype-এর ফ্রি ভার্সনে মাত্র ৫০ জন ইউজার একসাথে কনফারেন্স কল করতে পারে, সেখানে জুম সর্বোচ্চ ১০০ জন পর্যন্ত মানুষকে ৪০ মিনিটের ফ্রি ভিডিও কনফারেন্সিং সুবিধা দেয়।জুমের আয়ের মূল উৎস তাদের পেইড সাবস্ক্রিপশন প্যাকেজগুলো। Pro প্যাকেজে সকল বেসিক ফিচারসহ User management, Admin features control, ২৪ ঘণ্টার মিটিং ডিউরেশনের সুবিধা দিয়ে থাকে। যার জন্য প্রতিমাসে মাত্র ১৪.৯৯ ডলার ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে জুমের অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা একই সুবিধা দিতে আরও বেশি ডলার চার্জ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯.৯৯ ডলারে জুমের Business প্যাকেজ ক্রয় করলে, Pro এর সকল ফিচারসহ মোট তিনশ ব্যক্তি ওই ভিডিও কলে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। একই মূল্যে Enterprise প্যাকেজে Unlimited cloud storage এর পাশাপাশি, ভিডিও কলে মোট হাজারজন অংশ নিতে পারে। অন্যদিকে WebEx তাদের Business প্যাকেজে ২৬.৯৫ ডলারে সর্বোচ্চ ২০০ জনকে একত্রে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সুযোগ দেয়। স্বল্প ব্যয়ে অধিক সুবিধা পাওয়া কারণে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল প্রকার অফিস এবং বিজনেস মিটিংয়ের জন্য জুম একটি সাশ্রয়ী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। জুমের চমৎকার ইউজার এক্সপেরিয়েন্সের পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে, অ্যাপটি দারুণভাবে অপটিমাইজড। অন্যান্য সব অ্যাপের তুলনায় জুম তুলনামূলক কম ডেটা খরচ করে। তাই দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগেও তারা বেশ ভালো ভিডিও কলিং এক্সপেরিয়েন্স দিতে সক্ষম। জুম তাদের অ্যাপটি এমনভাবে ডেভেলপ করেছে, যেন তাতে কোনোপ্রকার বাগ বা ত্রুটি দেখা না দেয়। আবার জুম অ্যাপ খুব বেশি একটা ক্র্যাশ করতেও দেখা যায় না। ফলে এর ব্যবহারকারীরা বিষয়টি নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট। সেজন্যই ভিডিও মিটিংয়ের জন্য সবার পছন্দের শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে এই জুম। তাক লাগানো ফিচার এবং দুর্দান্ত সার্ভিস থাকা সত্ত্বেও এর নিরাপত্তা নিয়ে মাঝে প্রশ্ন উঠেছে। তখন ‘জুম-বোম্বিং’ নামে একটা শব্দ বহুল জনপ্রিয় হয়েছিল। কারণ, জুম অ্যাপে যে কয়টা বাগ বিদ্যমান ছিল, এর মধ্যে একটিতে হ্যাকাররা অন্যদের আলাপে আড়ি পাততে পারত। এজন্য অনেক বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা তখন জুম ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। নেতিবাচক খবর চারদিকে ছড়িয়ে যেতে লাগল। শুধুমাত্র লিংকে ক্লিক করে ভিডিও কনফারেন্সে জয়েন করার সুবিধা দেয়ার ফলে যে কেউ যেকোনো সময় ভিডিও কলে জয়েন করে ফেলতে পারত। আবার ব্যবহারকারীদের না জানিয়েই থার্ড পার্টির সাথে ইউজার ডেটা শেয়ার করার অভিযোগ এসেছিল জুমের বিরুদ্ধে। জুম মোবাইল অ্যাপ ২০২০ সালে ডাউনলোড হয়েছে ৪৮৫ মিলিয়ন বার। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ২৩ মিলিয়ন বার ডাউনলোড করা করা হয়েছে অ্যাপটি। এর মধ্যে ১৭ মিলিয়ন বার ডাউনলোড করা হয়েছে প্লে-স্টোর থেকে, বাকি ৬ মিলিয়ন আইওএস থেকে। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মিটিং ব্যবহারকারী যুক্ত হয় জুমে। অথচ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসেও সে সংখ্যাটা ছিল ১০ মিলিয়ন। ২০২০ সালের মার্চে ১০০ মিলিয়নে পৌঁছানোর পর, গড় ৩০০ মিলিয়ন অংশগ্রহণকারীতে জুম পা রাখে ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct