একজন শক্ত-সমর্থ মানুষকে চোখের জল ফেলতে দেখলে অবাক হতে হয়। কষ্টও হয়। সেদিন ভোরবেলায় আমি সে রকমভাবে অবাক হয়েছিলাম, কষ্টও পেয়েছিলাম। রোজকার মতো কাকভোরে বেরিয়ে পড়েছিলাম মর্নিং ওয়াকে। ছাতা পার্কের কাছে এসে দেখি ডানদিকের বেদিতে একটা কুয়াশার কুণ্ডলী। কুয়াশার কুণ্ডলীটা আস্তে আস্তে ভেঙে মিলিয়ে যেতে লাগল। একটা মূর্তি তৈরি হয়ে গেল। তাকিয়ে অবাক হলাম। আরে, এ যে আমাদের বাঙালির আইকন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সেই প্রকার নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। আজ প্রথম কিস্তি।
একজন শক্ত-সমর্থ মানুষকে চোখের জল ফেলতে দেখলে অবাক হতে হয়। কষ্টও হয়। সেদিন ভোরবেলায় আমি সে রকমভাবে অবাক হয়েছিলাম, কষ্টও পেয়েছিলাম। একটু খুলে বলি। রোজকার মতো কাকভোরে বেরিয়ে পড়েছিলাম মর্নিং ওয়াকে। ছাতা পার্কের কাছে এসে দেখি ডানদিকের বেদিতে একটা কুয়াশার কুণ্ডলী। যেন জমাট বেঁধে আছে। অথচ অন্য কোন দিকে সে রকম কুয়াশা নেই। ব্যাপারটা কি! কৌতূহলী হয়ে বেদিটার কাছে এলাম। কুয়াশার কুণ্ডলীটা আস্তে আস্তে ভেঙে ভেঙে মিলিয়ে যেতে লাগল। একটা মুর্তি তৈরি হয়ে গেল। ভালো করে তাকিয়ে অবাক হলাম। আরে, এ যে আমাদের বাঙালির আইকন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আমাদের অবদমিত আশা ও স্বপ্নের প্রতীক। ভাবলাম তাঁর ১২৫ বছর জন্মবার্ষিকী আমরা কেমন পালন করছি, তা নিজের চোখে দেখতে এসেছেন। কিন্তু তাঁর চোখে জল কেন? কাঁদছেন কেন তিনি? আমি কাছে গিয়ে বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন নেতাজি? কি হয়েছে আপনার? চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন তিনি। ধরা গলায় বললেন, আমি কি তোমাদের দাবার ঘুঁটি ? কি পেয়েছ তোমরা?তিনি কি বলতে চাইছেন, বুঝতে পারলাম না। সেটা বুঝতে পেরে তিনি বললেন, আমাকে নিয়ে এভাবে দড়ি টানাটানি করে অপমান করছ কেন?বুঝতে পারলাম এ বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসের ট্যাবলো নিয়ে নেতাজি বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি ট্যাবলো তৈরি করেছিল প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে প্রদর্শনের জন্য। মোদী সরকার সেই ট্যাবলো বাতিল করে দিয়েছেন। বলেছেন ‘সময়ের অভাব’। অথচ গত বছর মোদীবাবু ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে সারা বছর ধরে তাঁরা নেতাজির জন্ম দিবস পালন করবেন। ২৩ শে জানুয়ারি হবে ‘ পরাক্রম দিবস’। নেতাজি আমাকে দেখে নিয়ে বললেন, আমাকে নিয়ে এ রকম রাজনীতি কেন করছে এরা? আমি ঝট করে বলে বসলাম, বিজেপি বাঙালি ডিএনএর সন্ধানে ছিল। নেতাজি অবাক হয়ে বললেন, একটু খুলে বলতো! আমি বললাম, গত বছর ছিল এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ল বিজেপি রাজ্যটি দখল করার তালে ছিল। তাই হিল্লি- দিল্লি থাকে তাদের নেতারা রাজ্যে ডেলি প্যাসরঞ্জারের মতো উড়ে আসছিল। উড়ে এসে জুড়ে বসা আর কি ! তৃণমূল তখন তাদের ‘বহিরাগত’ বলে দেগে দিল। সে কথাটা দেশের মানুষ খেলোও বেশ। তখন বিজেপি সন্ধান করতে লাগলো বাঙালি ডিএনএ-র। তাই আপনাদের মতো মনীষীদের আপন করে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো।
নেতাজি বললেন দেখো আমার সময়ে তৃণমূল বা বিজেপি ছিল না। ছিল শুধু কংগ্রেস আর কমিউনিস্টরা। আমি অবশ্য ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেছিলাম। কমিউনিস্টরা আমাকে সন্দেহ করত, ‘তোজোর কুকুর’ বলতে ছাড়ে নি। পরের দিকে কংগ্রেসের সঙ্গেও আমার সম্বন্ধ খারাপ হয়ে যায়। জানি না, জওহরলাল আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতো কি না। আমি বললাম, তৃণমূল কংগ্রেস ভেঙেই হয়েছে। আর আপনার সময়ে বিজেপি না থাকলেও হিন্দু মহাসভা ছিল। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। নেতাজি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললেন, তোমার কথা শুনে বুঝলাম তৃণমূলই এখন এ রাজ্যের শাসকদল। আমাকে নিয়ে তারা ট্যাবলো তৈরি করেছে। ট্যাবলো বাতিল হতে তারা ‘নেতাজির অপমান’ বলে প্রতিবাদ করছে। তুমি কি নমে করো এই যে আমার পক্ষে কথা বলা, ট্যাবলো তৈরি করা, এ সব কি অহৈতুকী শ্রদ্ধার নিদর্শন? খুব কঠিন প্রশ্ন। সুভাষ বললেন, আসলে এটা দুই পক্ষের রাজনৈতিক লড়াই। আমি হলাম দাবার ঘুঁটি। কবিগুরুকেও দাবার ঘুঁটি করা হয়েছে। একটু থেমে তিনি প্রশ্ন করলেন, তুমি কি কবিগুরুর ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ পড়েছে? সেখানে এ দেশের রাজনীতি সম্বন্ধে তিনি একটা মোক্ষম কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস ’। মনে পড়ছে? মৃত্যুর পরে নানাজনের মুখে দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির যে সব কথা শুনেছি তাতে তো ঘেন্না ধরে গেছে। নেতাগুলো তো ব্রিটিশের সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। কেউ সংখ্যাগুরুকে নিয়ে, কেউ সংখ্যালঘুকে নিয়ে। বিভাজনের রাজনীতি। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি। শুধু ক্ষমতালাভের রাজনীতি। নীতিহীন রাজনীতি। সেই সঙ্গে ঘুষ, আর্থিক কেলেঙ্কারী। আর অঢেল প্রতিশ্রুতি। এমন কোন নেতা কি দেশে আছে যে বলতে পারবে ‘আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগোরে আমার দেশ?’চুপ করলেন নেতাজি। তাঁর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। আমি মৃদুস্বরে বললাম, আপনি ডাক দিয়েছিলেন ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’।নেতাজি চোখের জল মুছে বললেন, এ যুগের নেতা কি ডাক দেবে বলতো? সে বলবে, ‘ তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের বিশুদ্ধ গ্যাস দেবো’।
(ক্রমশ..)
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct