১৯১৩ সালের মে মাসে একদল ঐতিহাসিকদের সঙ্গে ইতিহাসের শহর নবাবের মুর্শিদাবাদে প্রথম এসেছিলেন। বহরমপুর থেকে হেঁটে লালবাগ গিয়েছিলেন। ছিলেন লালবাগের সাবিরুদ্দিন আহমেদের বাসায়। সেখানে তাঁর ঘি দিয়ে আলুসেদ্ধ ভাত খাওয়ার কথা তিনি লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘ভারত পথিক’ গ্রন্থে। তখন তিনি নিতান্তই বছর ষোলোর স্কুল ছাত্র। কৈশোরে তাঁর প্রথম আসা বন্ধু দঙ্গল নিয়ে, সিরাজের সমাধিক্ষেত্র দেখতে। মুর্শিদাবাদে নেতাজির দিনযাপন নিয়ে লিখেছেন জৈদুল সেখ।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন অখণ্ড ভারতের নির্বাসিত সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। এই মন্ত্রিসভা গঠন হয় ১৯৪৩ সালের ৩ রা অক্টোবর। তখনকার জাতীয় পতাকা ছিল আজকের ভারতের সেই তেরঙা পতাকা। সেনাবাহিনীর নাম ছিল আজাদ হিন্দফৌজ। আজাদ হিন্দ সরকারের মুদ্রা ও নানা সরকারি চিহ্ন ও সাক্ষর ছিল। এই সরকারকে রাশিয়া, জাপান ও থাইল্যান্ড সমেত ১২টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ কোহিমা জয় করে ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর মাসে আন্দামানে পতাকা উত্তোলন করেন। সারা ভারতবর্ষের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন লড়াই সংগ্রামে। দেশবরেণ্য, আপোষহীন স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবন দর্শন, লড়াই, সংগ্রামের অনেক উপকরণই রয়েছে মুর্শিদাবাদে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে জেলায় বিভিন্ন সময়ে বহরমপুর, বেলডাঙা, কান্দি, লালবাগ, জিয়াগঞ্জে, জঙ্গিপুরে এসেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯১৩ সালের মে মাসে একদল ঐতিহাসিকদের সঙ্গে ইতিহাসের শহর নবাবের মুর্শিদাবাদে প্রথম এসেছিলেন। বহরমপুর থেকে হেঁটে লালবাগ গিয়েছিলেন। ছিলেন লালবাগের সাবিরুদ্দিন আহমেদের বাসায়। সেখানে তাঁর ঘি দিয়ে আলুসেদ্ধ ভাত খাওয়ার কথা তিনি লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘ভারত পথিক’ গ্রন্থে। তখন তিনি নিতান্তই বছর ষোলোর স্কুল ছাত্র। কৈশোরে তাঁর প্রথম আসা বন্ধু দঙ্গল নিয়ে, সিরাজের সমাধিক্ষেত্র দেখতে। তবে তার পরে গ্রাম বাংলার এই প্রান্তিক জেলায় তাঁর আনাগোনা ঢিলেঢালা পাজামা পরে সিরাজের সমাধিক্ষেত্র দেখার পর্যটক হয়ে নয়, রাজনীতির শিক্ষক, সংগ্রাহক, পর্যবেক্ষক কিংবা প্রচারক হিসেবে। ‘আলোকপাত’ নামে প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থে ‘মুর্শিদাবাদে নেতাজি’ শীর্ষক লেখা থেকে জানা যায় সুভাষচন্দ্র বহরমপুরে এসেছিলেন ১৯১৩-১৪ সালের পরে ১৯২৩ সালে। তাঁকে সে বার রাজবন্দি হিসেবে বহরমপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। তবে পূর্ণ বয়সে সুভাষের নবাবের জেলায় পদার্পণ জেলবন্দি হিসেবে। হ্যাঁ, গ্রেফতারের পরে বহরমপুরের তদানীন্তন জেলেই ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে ৩ নম্বর রেগুলেশন আইনের বন্দী সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে আসা হয় বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে। ১৯২৩ সালে নেতাজিকে রাজবন্দি হিসেবে বহরমপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। জেলার ৭ নম্বর ঘরে রাখা হয়েছিল এই হাই প্রোফাইল বন্দিকে। এখন যেখানে বহরমপুর মানসিক হাসপাতাল। এক সময়ের বহরমপুরের কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার ছিল এই হাসপাতাল।
স্থানীয় পত্র-পত্রিকা, সরকারি গেজেট, পুরনো স্মৃতি হাতড়ে খোঁজ মিলছে, অন্তত বারো বার মুর্শিদাবাদে এসেছেন সুভাষ। বীরভূম ছোঁয়া কান্দির গোকর্ণ আর বড়ঞার পাঁচথুপিতেও এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র। মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার বড়ঞা থানার অন্তর্গত পাঁচথুপি গ্রামের জমিদার বাড়ির ঘোষ মল্লিক পরিবারের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতি আজও অমলিন। ১৯২৯ সালের মে মাসে একটি সভা সংগঠিত করতে পাঁচথুপিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আসেন এবং সেখানে সভা সম্পূর্ণ করার পর রাত্রিযাপন করেন পাঁচথুপির ঘোষ মল্লিক বাড়িতে। পাঁচথুপির ঘোষ মল্লিক পরিবারের তৎকালীন জমিদার সুনীল মোহন ঘোষ মল্লিকের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক সম্পর্ক ক্রমশ বেড়ে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সারা ভারতে জনসভা করে স্বাধীনতার জন্য আপোষহীন সংগ্রামের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন একসময়ে সুভাষ। ১৯২৯ সালের মে মাসের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর লেখা চিঠি আজও সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে ঘোষ মল্লিক পরিবারে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের লেখা সেই চিঠির মধ্যে উল্লেখ রয়েছে- “পাঁচথুপিকে ঠিক গ্রাম বলা চলে না শহরের ছাপ রয়েছে।” কিন্তু বাস্তবে আজও পৌরসভার অধীনে না হওয়ায় আক্ষেপ পাঁচথুপির বাসিন্দাদের। সুনীল মোহন ঘোষ মল্লিকের ছেলে সুদীপ মোহন ঘোষ মল্লিক জানান, ‘তাদের বাড়িতে নেতাজি এসে তার পিসির কাছে লুচি এবং আলুর দম খেতে চেয়েছিলেন। সেই লুচি, আলুরদম তৃপ্তিভরে খান নেতাজি। তবে নেতাজির পাঁচথুপিতে আসার কথা কোনোক্রমে ইংরেজদের কানে চলে যায় আর তখনই সেই খবর জানতে পেরে পাঁচথুপির ঘোষ মল্লিক বাড়ি থেকে ছদ্মবেশ ধরে বর্ধমানের উদ্দেশ্যে নদীর পাড় দিয়ে চলে যান।’ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে ঘরে রাত্রিবাস করেছিলেন সেই ঘর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু পাঁচথুপির ঘোষ মল্লিক পরিবারের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্ক এবং স্মৃতি আজও অমলিন। নবাবের দেশে রাজনৈতিক চক্রব্যূহ নবাবের আমল থেকে হলেও নেতাজি নবাবের দেশকে খুব ভালোবাসতেন। ১৯৩১ সালে ২ জানুয়ারি বেলডাঙার সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন। বেলডাঙা পুরাতন বাজারের হাজরা বাড়ির প্রাঙ্গণে তাঁর সভামঞ্চ হয়। তাঁর আগমন উপলক্ষে তাঁকে সম্মান জানাতে শহর জুড়ে ফুলের মেলা বসে গিয়েছিল। ১৯৩৯ সালের ১৪ জুন তিনি কৃষ্ণনাথ কলেজে এসেছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক দলের প্রচার ও দলের জন্য অর্থসংগ্রহের জন্য! সে কথা কলেজের শতবার্ষিকী উৎসবের স্মারক গ্রন্থে লেখা রয়েছে। মিরজাফর ছাড়া বাঙালি কেবলমাত্র বাংলাকে নয় সারা দেশকে পথ দেখিয়ে এসেছে আজীবন কাল থেকেই, তাঁরই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক দেশনায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। তাঁকে নিয়ে রাজনীতি করা দেশের পক্ষে ক্ষতির কুহেলিকা শুধু নয় মহাপাপ।
লেখক সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct