ব্রিটিশ পরিচালিত কুখ্যাত ঐতিহাসিক নিদর্শন
আন্দামান সেলুলার জেল
বেবি চক্রবর্তী
________________________
আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ওপর অবস্থান সেলুলার জেল। ব্রিটিশ পরিচালিত শাসন ব্যবস্থায় “ ইন্ডিয়ান জুডিশ্রীয়্যাল্ “ সিস্টেম্ ছিল অত্যন্ত কড়া ভারতীয় বিপ্লবী দের জন্য। তখন এই ইন্ডিয়ান পেনাল কোর্ট ছিল সেলুলার জেল। দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া মহাদেশের দু ‘প্রান্তে মহাসমুদ্র মাঝখানে ঘন জঙ্গল ওপর বিরাজমান “ সেলুলার জেল “। এই জঙ্গলের আদিবাসী ‘জারোয়া’ নামে পরিচিত।আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ যাকে কালাপানি বা ( Black Water) বলা হয়। জলপথ মাধ্যমে ছিল তখনকার দিনে যাতায়াত এর সুগম্ পথ। বিদেশে পড়তে গেলে এই “ কালাপানি ‘’র ওপর দিয়ে যেতে হত। ‘ কালাপানি’ এর ওপর দিয়ে গেলে বলা হত জাত চলে গেল। তাকে অচ্ছুঁত বলা হত এবং সমাজে তাঁকে একঘর করে দেওয়া হত। বিদ্যাসাগর এবং রাজারামোহন রায় প্রমুখ মণিষী’রা এই ‘কালাপানি’র ওপর দিয়ে বিদেশে পড়তে গিয়েছিল। তৎকালীন শোনা যেত বিদ্যাসাগর’কে অচ্ছুঁত বলে নিজের মা’এর সাথে দেখা পর্যন্ত করতে দেয়নি। শুধুমাত্র অচ্ছুঁত বলে গণ্য করে তখনকার সমাজ কুসংস্কার আচ্ছন্ন মনোভাবাপন্ন একঘর করে দিয়েছিল। ‘কালাপানি’একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ‘কালাপানি’পেরিয়ে গেলে সমাজে অচ্ছুঁত বলে গণ্য করা হত। অনেক বিল্পবী স্বাধীনতা জন্য এই জেলে প্রাণ দিয়েছিলেন। বিনায়ক দামোদর সভাকর, সুধাংশু দাশগুপ্ত, হরে কৃষ্ণাণ কংকর, বটুকেশ্বর দও, যোগেন্দ্রনাথ শুক্লা, অম্বিকা চক্রবর্তী, চণ্ডীবমন্ পিলাই, কল্পনা দও প্রমুখ। রক্ত ঝরতো চোখের জলে,বিপ্লবীদের ওপর কঠোর ভাবে অত্যাচার করত। হাত বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। খালি গা’য়ে বেতে’র শত্ আঘাত। বেতে’র শত্ আঘাত চোখে দিয়ে অশ্রু ঝরত এর ওপর গরম তেল দেওয়া হত। কাউ’কে আবার বরফ্ এর চাই দিয়ে চেপে ধরত, গা’য়ের ওপর নুনে’র বস্তা চাপিয়ে দেওয়া হত তাঁরা উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল হাঁসতে হাঁসতে প্রাণ দেব তবু মুখ খুলব না -- “এই খাবার আমরা মুখে তুলবে না। আমারা ভারত মায়ের সন্তান বুক ফাঁটবে তবুও মুখ খুলবে না।” - তাঁদের ঘাম দিয়ে রক্ত ঝড়ে পড়ত। বিপ্লবী বুটুকেশ্বর দত্ত’কে মুখে জোর করে গলায় পাইপ ঢুকিয়ে শ্বাসরোধ করে মারা হয়।
আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ওপর সেলুলার জেলে তৈরী শুরু হয় ১৪৯৬ সালে এবং তৈরী শেষ হয় ১৯০৬ সালে। ভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলন ১৮৫৭ সালে ২০০ ভারতীয় বিপ্লবীকে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেলুলার জেলে প্রথম কাস্ট্যাডি ছিল ডেভিড বেরি এবং মেজর জেমস্ পেটিসন্,ওয়ালর্কার একজন মিলিটারি ডাক্তার। কারাচী অর্জন ১৮৬৩ সাল থেকে ১৮৬৪ সাল। হেনরি ফিসার্ ছিল বাংলায় তথ্য সংগ্রহ কারী “অ্যাডামানস্ হোম্” ১৮৬৬ সালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল ST. Luke’h Church তিনি পরে মারা যান। Old “Christian Cemetery Abbottabad “। মোঘল সম্রাট বাহদুর শাহ্ জাফর ঠিক এই সময় মধ্যস্থতা জন্য ‘Petition ‘ জমা করেছিল। আইসল্যান্ড এটি কালাপাণি নামে পরিচিত। এখানে হাই সিকিউরিটি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ‘Charles James Lyell was served as Home Secretary in the Raj Government’ -- যে ইন্ভেস্ট্রিকেশান্ পেনাল্ কোর্টে বিচার করা হত পোর্ট বার্লিতে। তখন সার্জেন্ট ছিল এ.এস. লেথ্ ব্রিজ্ ব্রিটিশ শাসক্ শাস্তি ছিল “Transportation” আন্দামান আইল্যান্ডে। লেরি এবং লেথ ব্রিজ Recomended that a “Penal Stage”। সেলুলার জেলে মোট ৬৯৬ টি জেল ছিল “ 4.5 by 2.7 metres (14. 8 ft × 8.9ft ) in size with a ventilator Located ata height of 3 metres (9.8 ft)”। বলা হয় সেলুলার জেলে নুনের বস্তা চাপিয়ে দেওয়া হত। ঝুলিয়ে দেওয়া হত দু’হাত বেঁধে। বেঁতের আঘাত করা হত খালি গায়ে। ফজল-ই-কু কাবিরাবি, যোগেন্দ্রনাথ শুক্লা, বটুকেশ্বর দও বাবারও সাভারকর, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, শচীন্দ্রনাথ সানওয়েল,ভাই পরমানন্দ,মোহন সিং, সুবোধ রায়, তিলকনাথ চক্রবর্তী। আলিপুর কেস্ (১৯০৮) বীরেন্দ্র কুমার ঘোষ এবং বাঘাযতীন’কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বহরমপুর জেলে আগে অবিশ্বাস্য ভাবে মৃত্যু ১৯২৪ সালে। মার্চে ১৮৬৪ সালে ২৩৮ জন বিপ্লবী পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে। তাঁদের একটাই মন্ত্র ছিল উধ্বস্বরে চিৎকার করতে করতে “ আমরা ভারত মায়ে’র সন্তান মরব তবু মুখ খুলব না”। সুপারইনটেনন্ডেন্ট্ এর নির্দেশে ৮৭ জন’কে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। “Hunger Strikes” এ ১৯৩৩ সালে মে’ তে জেলে’র অর্থরিটি’র কাছে ধরা পড়েছিল। আনুমানিক ৩৩ জন বিপ্লবী’র পক্ষে মামলা ছিল প্রতিবাদে’র। “Hunger Strike” - এর বিরুদ্ধে জেলের মধ্যে প্রতিবাদে অনশনে বসেন মহাবীর সিং এর অনুগামী ভগৎ সিং ( লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা) মদন কিশোর নামদাস এবং মহিত মৈত্র ( Convicted in Arms Act Case)। বিপ্লবী 31552 ‘উল্লাস কর দত্ত’ বাড়িতে বোমা তৈরি’র অভিযোগে ধরা পড়ে মুজাফ্ফর পুরে। বটুকেশ্বর দও, যোগেন্দ্রনাথ শুক্লা, রামপ্রসাদ বিসমিল্লা এবং ইউসুফখুল্লা খান্ ( কাঁকরি ষড়যন্ত্র মামলা ) “Hunger strike” এর বিরুদ্ধে অনশনের পথ প্রথম শুরুকরেছিল তাঁরপর একে একে বিপ্লবী’রা অনশনে বসে। হত্যা করেছিল ব্রিজ এর সহকর্মী ডুগ্লাস্ কিং ফ্রোড্’কে। চিফ্ প্রেসিডেন্ট্ মেজিস্টেট্ পিজেল্ কেনেডি এবং তার কন্যা গ্রাস্’কে হত্যা করার অপরাধে তাঁকে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। Lunatic word at Haddon তাঁকে চোদ্দ্ বছরে’র জন্য জেল দেওয়া হয়।
31549 :- বিরেন ঘোষ।
31555 :- বাসুদেব রয় ( তাঁকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং পিঠে গরম তেল দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
38360 :- চার্টার সিং তাঁকে তিন বছরের জন্য সাসপেন্ড্ করে দেওয়া হয়েছিল
38511 :- বাবা ভানু সিং তাঁকে পিঁটিয়ে মেরেছিল ডেভিড্ বেরী।
41054 :- রাম রার্কসা তাঁকে বুকে’র ওপর নুনের বস্তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
146 :- হরিপদ চৌধুরী।
147 :- ভীরেন চৌধুরী ( বোমা ও বন্দুক তৈরী’র জন্য ধরা পড়ে) তাঁদেরকে জেলে’র মধ্যে গুলি করে মারা হয়।
নীরেন সিং:- তাঁকে পা’বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
15557 :- স্যার্ আলি তাঁকে হত্যা করেছিল লর্ড মেয়র। (ফেব্রুয়ারী’তে ১৮৭২ সালে ঝুলিয়ে রাখা হয় মার্চ এগারো ১৮৭২ সাল পর্যন্ত তাঁকে এই ভাবে রাখা হয়েছিল।)
12819 :- মেহেতাব্
10817 :- চইতুন্ তাঁরা আইসল্যান্ড্ থেকে চুরি করে পালাচ্ছিল মার্চ এর ছাব্বিশ তারিখে ১৮৭২ সালে।পালাতে গিয়ে তাঁরা ধরা পড়ে তাঁদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁরা কর্নেল্ হাগস্ এর বাড়ির মালিক এবং ফটোগ্রাফার্ এর ওপর হামলা করে।
68 :- মহাবীর সিং যখন তাঁকে মাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হল “The Yard Five Wing” রাত আট’টাতে ঘন্টা আবার বাজল। প্রত্যেক বিপ্লবী জেলে’র ভিতরে বসেই মহাবীর সিং এর জন্য সবাই মিলে চিৎকার করতে লাগল “ ইনক্লাব্ জিন্দাবাদ্ “ একুশ জন বেরিয়ে এল সেন্টাল্ টাওয়ার থেকে। তারা ব্যর্থ হল খাওয়া’তে ডাক্তার যুদ্ধ করল বিপ্লবী’রা আওয়াজ তুললো “ ইনক্লাব জিন্দাবাদ্” বন্ধুকের গুলিতে মধ্যরাতে Dr Edge দেখল পেনাল্ কলনি হসপিটালে মহাবীর মৃত।
89 :- মোহন কিশোর ।
93 :- মোহিত মিত্র জোর করে শ্বাসরোধ করে মারা হয়।
61 :- নারিন ( জেল থেকে পালাতে গিয়ে মারা যায় কালাপানি’তেই। ডাক্তার ওয়ালর্কার এটা ঘোষণা করেন। মহাত্মাগান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেলুলার জেলে ১৯৩৭ - ৩৮ সাল। “The Cellular Jail was forced to empty in 1936। এর দু’বছর পর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জাপান থেকে আইসল্যান্ড এসে যুদ্ধ ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে ওঠে ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে। ঊনিশোতেতাল্লিশ্ খ্রিস্টাব্দের একুশে অক্টোবর নেতাজি সিঙ্গাপুরে ‘আজাদ্ হিন্দ সরকার’ বা ‘স্বাধীন ভারত সরকার’ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। তেইশে অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই জাপান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি প্রভৃতি নয়টি রাষ্ট্র এই আজাদ্ হিন্দ সরকার’কে স্বীকৃতি দেয়। ছয়’ই নভেম্বর জাপানের প্রধানমন্ত্রী তেজো আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দুটি আজাদ্ হিন্দ সরকার এর হাতে তুলে দেন। একত্রিশে ডিসেম্বর এই দুটি দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন ‘শহীদ ‘ ও ‘স্বরাজ্’। দলে দলে ভারতীয়রা আজাদ্ হিন্দ বাহিনীতে যোগদান করেন। আন্দামানে এই মহান্ বিপ্লবীদের আদর্শে’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ‘জয়হিন্দ্’ ধ্বনি দিয়ে অভিবাদন জানায়। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ওপর প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন হয়েছিল বিজয়ী শিখরে বঙ্গীয় মায়ের সন্তান শত্ শত্ বিপ্লবী যারা নিঃস্বার্থ ভাবে প্রাণ দিয়েছিল দেশ মাতা’র জন্য সেইসব তৃষ্ণা প্রয়াসু অতৃপ্ত বাসনা সাধ্ ও শান্তি পেয়েছিল ভারত যখন উনিশশো পঁয়তাল্লিশে স্বাধীন ঘোষণা করল। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় বিপ্লবীদের আদর্শ এবং অবদান এবং দেশের প্রতি যে শ্রদ্ধা তা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct