সংবিধানের ৩০ ধারা
মুন্সী আবুল কাশেম
___________
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইসলামিক (মাদ্রাসা) শিক্ষার হাল-হকিকত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বা মতপার্থক্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে বা এক কথায় বলা যায় এই বিতর্ক ‘চির-প্রবহমান’। সাধারণ ভাবনায় আমরা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামিক শিক্ষা ধারার মর্যাদা দিয়ে থাকি। ‘মাদ্রাসা’ শব্দের উৎপত্তি আরবা শব্দভাণ্ডার থেকে। ‘ইয়া দোরুসু’ থেকে ‘মদারাসা’ এবং তার থেকে মাদ্রাসা শব্দের আবির্ভাব এবং ধারা এই শিক্ষা দানে নিবেদিত প্রাণ তাদেরকে ‘মদারেস’ বলা হয়। শুরু হয়েছিল ‘আল্-উলুম-আল্আখ্লিয়া’ অথবা ‘আল্-উলুম-আল্-নাখলিয়া’ কোনটি গ্রহণযোগ্য? বিতর্ক সম্ভবত আজও থামেনি। তাই আমরা দেখতে পাই ‘দারস-ই নিজামিয়া’ শিক্ষা পদ্ধতির পাশাপাশি পরিচালিত হচ্ছে ইংরেজি শব্দ ভাণ্ডার থেকে ‘ধার করা’ দুটি অনন্য সাধারণ উপহার ‘হাই মাদ্রাসা’ ও পাশাপাশি ‘সিনিয়র মাদ্রাসা’ এবং মুসলিম সমাজের জন্য যথেষ্ট গৌরবের ও সৌভাগ্যের বিষয় ‘হাই মাদ্রাসা’ ও ‘সিনিয়র মাদ্রাসা’র যাবতীয় পরিচালন ব্যবস্থা ও অর্থ বরাদ্দ সরকারি তহবিল থেকে হয়ে থাকে। ‘দারস্-ই-নিজামিয়া’ বা সহজ ভাষায় খারিজি মাদ্রাসা পরিচালিত হয় মুসলিম সমাজের নিজস্ব দানকরা অর্থ ভাণ্ডার থেকে - সরকারি আর্থিক সাহায্যে নয়। আমরা রয়েছি এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মাঝে। সামাজিক উন্নয়নে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রহণযোগ্য? ‘খারিজি মাদ্রাসা’, ‘সিনিয়র মাদ্রাসা’, ‘হাই মাদ্রাসা’ অথবা নতুন স্বপ্ন নিয়ে আত্মপ্রকাশিত ইংলিশ মিডিয়াম ‘হাই মাদ্রাসা’ - নাকি ইংরেজ সরকারের ফেলে যাওয়া ‘হাই স্কুল’ শিক্ষা পদ্ধতি। বিতর্কের ঝাঁঝ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, কিন্তু. শেষ কোথায়? আমাদের দেশে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট। স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত হল বটে কিন্তু দেশটা দু-ভাগ বা তিন-ভাগ হয়ে গেল এবং তা হল অল্প কিছু মানুষের বিতর্কিত ধর্মীয় নীতি ও আদর্শের অপব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে। স্বাধীন ভারতের আত্মপ্রকাশ ঘটল এই ভাষায়, ‘আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তোলার সংকল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম’। দুশো বছরের বিদেশি ইংরেজ শাসন ভারতীয় জনগণকে মোটামুটি দুটি ভাগে
বিভক্ত করেছিল - ‘মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ / মাটির মালিক তারাই হ’ন’ - অর্থাৎ জমিদার তথা ‘প্রভু’ শ্রেণী (১৭৯৩) আর বাকি সব হতভাগ্য ‘নিষ্পেষিত’দের দল। ‘প্রভু’দের জন্য তৈরি হল শহর, নগর, রাস্তা-ঘাট, উন্নতমানের যানবাহন, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, পুল-ব্রিজ ইত্যাদি হরেক রকমের আধুনিক জীবন সভ্যতার বাহন আর গ্রামের মানুষরা পড়ে রইল রিক্ত-নিঃস্ব, অর্ধবসনাবৃত অন্ধকার জগতে। অন্ধকার জগতের মানুষ কারা? তারা হল তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি ও মুসলিম সমাজের বৃহৎ সংখ্যক মানুষ - যাদের পরিচয় শৈলেন সাঁফুই, শৈলেন মাহাতো, আকবর সাঁফুই ইত্যাদি নামে। অবশ্য ধর্মাচরণে শৈলেন সাঁফুই আর শৈলেন মাহাতো হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। অন্যদিকে আকবর সাঁফুই মুসলিম সম্প্রদায় ভূক্ত। সকলেরই অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন। ইংরেজ পূর্বযুগে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। হিন্দুদের জন্য ছিল সংস্কৃত ভাষা নির্ভরশীল ‘টোল শিক্ষা’ ব্যবস্থা আর মুসলিমদের জন্য ছিল আররি ভাষা নির্ভরশীল ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’ ব্যবস্থা। দেব-দেবীর সান্নিধ্য পেতে হলে তাদের ভাষা ‘সংস্কৃত’ আয়ত্ত করতে হবে, অন্যদিকে পরম প্রিয় আল্লাহকে পেতে হলে তার ভাষা ‘আরবী’ অবলম্বন করতে হবে। কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষে চাষের জন্য জলের দরকার / পানির দরকার। তাই দেবতা বা আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে হলে তাদের ভাষায় তাদেরকে ডাকতে হবে - ‘টোল’ এবং ‘মাদ্রাসা’ শিক্ষার লক্ষ্য এই লাইনে সীমাবদ্ধ। ইংরেজ সরকার ১৮৩৫ সালে ‘স্কুল শিক্ষা’ ব্যবস্থা চালু করেন যে শিক্ষা ধারায় বিজ্ঞান, অঙ্ক, ইংরেজি, দর্শন শেখার উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। তারা বললেন - স্রষ্টার সৃষ্টি বিজ্ঞান শিক্ষার বিষয়বস্তু। সৃষ্টির মধ্যে সন্নিবেশিত অদৃশ্য রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলে মানুষ স্বচ্ছ-সাবলীল জীবনে পৌঁছাবে - শূন্য হাতে আসা মানুষ মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করতে সক্ষম হবে। পরমপ্রিয় আল্লাহ্ মানুষের জন্য যে সম্পদ দিয়ে সমগ্র বন্ড জগত সৃষ্টি করেছেন তার অদৃশ্য রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে অঙ্ক, বিজ্ঞান আয়ত্ত করতে হবে। এ দেশের হিন্দু সমাজ ‘স্কুল শিক্ষা’ ব্যবস্থায় (চুঁইয়ে পড়ার ভিত্তি ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও) আত্মনিয়োগ করল, কিন্তু কারণ যাই থাক মুসলিম সমাজ ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুতেই মেনে নেয়নি। ফলে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়ার গতি পিছিয়েই রইল। স্বাধীন ভারত কিভাবে পরিচালিত হবে, তার রূপরেখা তৈরি করার জন্য লিখিত সংবিধানের আত্মপ্রকাশ হল ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর। নেতৃত্বে ছিলেন ড. বি আর আম্বেদকর। সঙ্গে ছিলেন এন গোপালস্বামী আয়েঙ্গার, আল্লাদী কৃষ্ণস্কামী আয়ার, কে. এম্ মুন্সী, সৈয়দ মহম্মদ শাহেদুল্লাহ, ডি. পি. খৈতান টি. টি. কৃষ্ণমাচারী), বি এল মিত্র (এন. মাধব রাও)। ভারতীয় সংবিধান মূলত ৩৯৫টি অনুচ্ছেদ, ২২টি ভাগ এবং ১২টি তফসিলে বিভক্ত। পরবর্তীকালে কিছু সংযোজন হয়েছে - সেটা ভিন্ন কথা। বলা হল সকল নাগরিকের জন্য সমান বিচার, সমান স্বাধীনতা, সকলের মধ্যে সমতা ও ভ্রাতৃত্বরোধ গড়ে তোলা, বজায় রাখতে হবে জাতীয় এক্য ও অখণ্ডতা। সংবিধানের তৃতীয় অংশে (281-III, ধারা ১২ থেকে ৩৫) নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার বলতে আমরা সেগুলিকে বোঝাই যেগুলি ব্যক্তিত্ব বিকাশের পক্ষে একান্ত অপরিহার্য। একথা বলা হয়েছে যে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কিংবা মৌলিক অধিকার খর্বকারী কোনও আইন দেশের পার্লামেন্টে বা রাজ্য বিধান সভায় প্রণীত হলে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দিতে পারবেন। সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার যা ২৯, ৩০ ধারায় লিপিবদ্ধ হয়েছে সেটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য এক অনন্য সাধারণ মৌলিক অধিকার। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল সুচিন্তিত ও সুগঠিত জনমত গঠন করা। জনগণ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন যদি অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার প্রভৃতিতে আচ্ছন্ন থাকে তবে স্বাভাবিকভাবে তাদের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে না। সংবিধানের ২৯ ধারা ও ৩০ ধারায় সংখ্যালঘু সমাজের সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার ঘোষিত হয়েছে।
তন্মধ্যে ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, ৩০( ১) ধারা ‘All Minorities whether based on religion or language, shall have the right to establish and administer educational
institutions of their choice.’ ৩০ ( ২) ধারা ‘The state shall not, in granting aid to educational institutions, discriminate against any educational institution on the ground
that it is under the management of a minority, whether based on religion or language.’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠা পেলে সংখ্যালঘু সমাজ নিজ প্রচেষ্টায় নিজ সমাজ তথা সকল নাগরিককে উন্নততর শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারবে, যাতে তারা ভারতের উপযুক্ত নাগরিক হিসাবে নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এপ্রসঙ্গে নাগরিকদের শিক্ষায় মৌলিক দায়িত্ব সম্পর্কে সংবিধানে ঘোষিত নির্দেশ স্মরণ করা প্রয়োজন। বলা হয়েছে :
51(A) It shall be the duty of every citizen of India :
(h) to develop the scientific temper, humanism and sprit of inquiry and reform and
(k) who is a parent or guardian to provide opportunities for education to his child or, as the case may be, ward between the age of 6 and 14 years.
সংবিধান প্রদত্ত উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার মৌলিক অধিকারের ক্ষমতা (৩০ ধারার অধিকার) দেওয়া থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের মধ্যে অথবা মাননীয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে ২০০৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত এ বিষয় নিয়ে বিশেষ কোন চর্চা হয়নি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও দেশ ভাগের ফলে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মুসলিম নাগরিক প্রাথমিক অবস্থায় যথেষ্ট সংকোচের মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়, ফলে উপযুক্ত মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের চিন্তাভাবনায় যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটে। বেঁচে থাকাটাই তো যথেষ্ট - শিক্ষা তো পরের কথা। এমত পরিস্থিতিতে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সংবিধানের ১৫ ধারায় প্রদত্ত নাগরিকের এক অনন্য সাধারণ মৌলিক অধিকারের নির্দেশ। বলা হয়েছে, ধারা ১৫ - ‘The state shall not discriminate against any citizen on grounds only of religion, race, caste, sex, place of birth or any of them.’ অর্থাৎ, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মস্থান অথবা সেগুলির যেকোন একটার ভিত্তিতে রাষ্ট্র নাগরিকবৃন্দের কাউকে পৃথক (বৈষম্য) করে দেখবেন না। কিন্তু প্রশ্ন হল যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ না হলে অধিকার রক্ষিত হবে কিভাবে। ধরা যাক সরকারি প্রশাসনে বিডিও নিয়োগ করা হবে। বিধান অনুযায়ী যে কেউ বিডিও হতে পারে কিন্তু তাকে যোগ্যতা মাপের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এই যোগ্যতা মাপের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়োজনীয় শিক্ষালাভের সুযোগ যদি দেশের সকল মানুষের জন্য সমভাবে না থাকে তাহলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিডি. হবে কিভাবে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে ইংরেজ সরকার দেশের সমাজকে দু-ভাগে ভাগ করেছিল : ১) উচ্চবর্ণ ২) নিম্নবর্ণ। বিভাজন ছিল গ্রাম ও শহরের মধ্যে। শিক্ষা বিবর্জিত গ্রামের মানুষ সমান অধিকার (১৫/১ ধারা) পাবে কিভাবে? এইরূপ অভাব
দুর করার উদ্দেশ্যে সংবিধানের ১৫৫৪) ধারা সংযোজিত হয়। বলা হল - ‘Nothing in this article or in clause (2) of article 29 shall prevent the State from making any special provision for the advancement of any socially and educationally backward classes of citizens or for the Scheduled Castes and the Scheduled Tribes.’ অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া সমাজকে তিন ভাগে ভাগ করা হল (ক) যারা শিক্ষা ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া (খে) যারা তফসিলি জাতিভুক্ত সমাজ, (গ) যারা তফসিলি উপজাতি ভুক্ত সমাজ। দেশের এই তিন ধরনের মানুষকে চিহ্নিত করে তাদের শিক্ষা ও সামজিক উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সরকারের উপর ন্যস্ত হল। তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি হিসাবে কোন কোন শ্রেণীর নাগরিক চিহ্নিত হবেন - তার সংজ্ঞা ভারতীয় সংবিধানে দেওয়া আছে। বলা হয়েছে তারা হবেন ধর্মে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পাঞ্জাবি, সাঁওতাল, মুণ্ডা ইত্যাদি। কোনও মুসলিম বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কেউ এই বিভাগে চিহ্নিত হবেন না - যদিও তারা মণ্ডল, নস্কর
সরদার, গায়েন, বায়েন ইত্যাদি পদবির অধিকারী হোন বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত হোন। শিক্ষা ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তালিকা নির্ধারণ করার তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠী এই ধারায় চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুসলিম সমাজকে এই তালিকায় স্থান দেওয়া হয়নি। সেই কারণে মুসলিম সমাজ পূর্বে যেমন পিছিয়ে ছিল এখনও তেমন পিছিয়ে আছে (অবশ্য সাচার কমিশনের রিপোটের ভিত্তিতে ২০০৮ সালের পর কিছু পরিবর্তন হয়েছে)। উপায়ান্তর না দেখে মুসলিম সমাজ তাদের পূর্বতন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে নবরূপে সজ্জিত করার প্রস্তাব নিলেন। মাদ্রাসার সম্মুখে ইংরেজি ‘সিনিয়র’ ও ইংরেজি ‘হাই’ কথাটি সংযুক্ত করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা হিসাবে জনসমক্ষে তুলে ধরার ব্যবস্থা নিলেন এবং মাননীয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার সে ব্যবস্থাকে মান্যতা দিলেন। মাদ্রাসাগুলির পক্ষে অনুমোদন ও সরকারি সাহায্য বরাদ্দ করলেন। মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ গঠন করলেন এবং পরবর্তীকালে ‘সিনিয়র মাদ্রাসা’ ও ‘হাইমাদ্রাসা’ শিক্ষার উপর সরকারি পূর্ণকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করলেন। ভারত সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং সরকার (তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন ড. এপিজে আব্দুল কালাম, রুলিং পার্টির সভাপতি ছিলেন শ্রীমতি সোনিয়া গান্ধী) ভারতীয় সংবিধানের ৩৪০ ধারার নির্দেশ অনুযায়ী মহামান্য বিচারক সাচার সাহেবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন (২০০৫ সালে)। উক্ত কমিশনের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে কিনা তা দেখা এবং পিছিয়ে থাকার কারণটা কি এবং তা প্রতিকারের উপায় কি হবে তা নিয়ে রিপোর্ট দেওয়া। মাননীয় সাচার সাহেব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রিপোর্ট দিয়েছিলেন যে ভারতীয় সংবিধানের ৩০ ধারায় উল্লেখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের পক্ষে কার্যকর রূপ পায়নি তাই তারা শিক্ষা ও আর্থসামাজিক জীবনে যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে ৩০ শে জুন মাননীয় পশ্চিমবঙ্গ
সরকার বিদ্যুৎ গতিতে প্রতিষ্টা করেন Minority Affairs and Madrasah Education Department যার মাধামে অনুসন্ধান চালানো হয় মুসলিম সমাজে কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে সরকারি অনুমোদন পেয়েছে এবং সরকারি আর্থিক সাহায্য লাভে
সমর্থ হয়েছে তা খুঁজে বার করা। গাইড লাইন প্রকাশিত হল। প্রারম্ভে বলা হল : Foridentification of such minority educational institution already established and are being administered as such the State Government shall verify the status of such institutions in the light of norms prescribed hereunder and issue necessary certificate so that such institutions can be associated with various state-aid schemes for education intervention in minority development. অনেক খোঁজাখুঁজির পর সরকার (GUIDELINES FOR RECOGNITION OF MINORITY EDUCATIONAL INSTITUTION IN W.B. Vide GO NO - 942-MD dated 30.06.2008) এই গাইড লাইনের (১৯) ধারা প্রয়োগ করে ঘোষণা দিলেন ‘ Notwithstanding anything contained in the foregoing criteria the State Govt. may suo moto declare any educational institution as Minority Educational Institution
which in the opinion of the Govt. satisfied the spirit of Art 30(1) of the onstitutions
of India and was recognized and aided by the Govt. before coming into effect of the
procedure herein prescribed.’ অর্থাৎ মাননীয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এইরূপ সিদ্ধান্ত করেন যে সরকারি অনুমোদিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেগুলি মুসলিম মাইনরিটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সরকারি সাহায্য পাচ্ছে সেগুলির পক্ষে সংবিধানের ৩০ (১) ধারার বিধান অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে Suo-moto মাইনরিটি স্ট্যাটাস বরাদ্দ হবে। সেগুলি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? - উত্তর: ‘সিনিয়র মাদ্রাসা’ ও ‘হাইমাদ্রাসা’। মাননীয় সরকার বললেন এইগুলি প্রকৃত Educational Institutions এবং মাইনরিটি স্ট্যাটাস পাওয়ার যোগ্য। কারণ এগুলির পক্ষে সরকারি অনুমোদন আছে এবং সরকারি অর্থ সাহায্য বরাদ্দ হয়েছে। প্রশ্ন উঠল মুসলিম সমাজের লোকেরা যদি স্কুল বা
কলেজ স্থাপন করেন এবং সেগুলি যদি সরকারের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান হয়, তার উপর যদি সংবিধানের ৩০ ধারার (মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) মর্যাদা যুক্ত হয় সেগুলির পক্ষেকী ৩০(২) ধারার বিধান মতে সরকারি আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ হবে? বিনা দ্বিধায় সরকারের উত্তর: না - তা হবে না। সরকারি বিধিমতে MAME দফতরের দায়িত্ব হল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে (হাই ও সিনিয়র) দেখভাল করা এবং আর্থক অনুদান বরাদ্দ করা। মাইনরিটি স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত কোন স্কুলের প্রতি তাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। অন্যদিকে স্কুল বিভাগের বক্তব্য হল মাইনরিটি স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত স্কুলের দায়ভার বহন করার দায়িত্ব Minority বিভাগের - স্কুল বিভাগ সেই দায়িত্ব পালনের ভারপ্রাপ্ত নয়।
বিচার কোথায়?
আবার প্রশ্ন উঠল ৩০(২) ধারায় বলা হয়েছে মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়দায়িত্ব সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে না। কিন্তু হল কী? সমস্ত মাইনরিটি স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত ‘হাই মাদ্রাসা’ ও ‘সিনিয়র মাদ্রাসা’ পুরোপুরি সরকারি কর্তৃত্বাধীনে চলে গেল। সরকারের মাননীয় মন্ত্রীরা বলতে থাকেন, ‘আমরা অর্থ দিই, তাই পরিচালনার দায়িত্ব আমরাই পালন করব ‘ যেটি পুরোপুরি ৩০ ধারার বিপরীত। রামকৃষ্ণ মিশন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল) পরিচালনা করে তারা নিজেরা, কিন্তু মাননীয় সরকার আর্থিক সাহায্য দেয়। খ্রিস্টান মিশনানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল) দায়দায়িত্ব সরকার বহন করে না। কিন্তু মুসলিম সমাজের জন্য পৃথক আইন (সরকারি পরিচালনাধীন) কেন হবে তার উত্তর কি? সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন আমরা নিজেরা পালন করব তেমনি আমরা অবশ্যই চাইব যে সরকার তাদের সাংবিধানিক দায়দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করুন। মাইনিরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার অধিকার ফিরে পাক - তা আমরা অবশ্যই চাইব আর এই উদ্দেশ্যে আমরা গঠন করেছি Association of Indian Minority Schools.
আমরা চাইব সেই স্কুল যেখানে ইসলামিক বিধান মতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি সবিশেষ যত্ব নেওয়া হবে৷। স্রষ্টাকে চিনতে হলে তাঁর সৃষ্টির অদৃশ্য রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে -এই জন্যই প্রয়োজন ‘অজানাকে জানার শিক্ষা’ যা হবে সকল ‘মানব সমাজের’ জন্য তার জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ যাই হোক না কেন এবং এটি পবিত্র কুরআনের মর্মবাণী। পবিত্র কুরআনের অমুল্য বাণী দিয়ে বক্তব্য শেষ করছি যেগুলি আমাদের
Association of Indian Minority Schools এর Memorandum of Association এর মূল কার্যকরী বিষয়:
‘নিশ্চয় আসমান ও জমিনের সৃজনে এবং দিন ও রাতের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা করে এবং বলে - হে আমাদের প্রতিপালক ! তুমি এসব বৃথা সৃষ্টি করনি।’ (সূরা আল-ই ইমরান : ১৯০-১৯১)
৬৭: ২- ‘তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন - কে
তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম?’ (সূরা মুলক : ২)
৬৭: ৩- ‘তিনি স্তরে স্তরে সপ্তআকাশ সৃষ্টি করেছেন, তুমি দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন খুঁত দেখতে পাবে না; আবার তাকিয়ে দেখ কোন ত্রুটি দেখতে পাও কিনা? অতঃপর তুমি বারবার তাকাও, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে।’ (সূরা মুলক : ৩-৪) ‘যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে তারাই সৃষ্টির সেরা।’ (সূরা বায়য়্যেনা: ৭)
৯৬ : ১-৫- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের নামে পাঠ করো, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। তুমি পাঠ করো, তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’
(সূরা আলাক : ১-৫)
(লেখক সংখ্যালঘু আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সম্পাদক শিশু বিকাশ একাডেমি ও অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ান মাইনরিটি স্কুলস)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct