সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১১ কিস্তি ৩
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
‘সোপান’ নাট্যসংস্থার ঘরে বিধ্বস্ত পল্লব পায়চারী করছিল। বিচিত্র ভাবনা তার মাথার ভিতরে। কিছুতেই কোনো হিসেব মিলছে না। কোথা থেকে যেন কত কী হয়ে গেল অথচ শুরুটা হয়েছিল ভীষণ আশা নিয়ে। আসিফ এল আরও কিছুক্ষণ পরে। তাকে ভয়ানক মনমরা লাগছিল। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল ঘরের এক কোণে। চাপা স্বরে প্রশ্ন করল পল্লব, হারে, মাসিমা কেমন আছে? আসিফ কোনো উত্তর দিল না। গুম হয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। একবার ভাবল, পল্লবদার কাছে কিছু টাকা ধার চাইলে কেমন হয়? আবার ভাবল, মায়ের অসুস্থতার কথা বলে যে টাকা নিয়েছে সে, তা শোধ করা সম্ভব হয় নি। পল্লবদা খারাপ ভাবতে পারে। মানসিক সংকোচে দুলতে লাগল আসিফ। তা এত প্রকট হয়ে উঠল যে কিছুতেই সে ভিতরের চাহিদার কথা প্রকাশ করতে পারল না।অমন চুপ করে থাকলি যে? প্রশ্ন করল পল্লব। তোমার ভজহরির রোলটা নিয়ে ভাবছি। পল্লব একটু হাসল। আমার ভজহরি বলছিস্ কেন? মানে দুজনে এক গ্রামের বাসিন্দা। তা হতেই পারে। নানা মানসিকতার লোক এক গ্রামে থাকতে তো কোনো অসুবিধা নেই। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল আসিফের বুকের গভীর থেকে। তাহলে কী ভজুর বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই করার নেই? আমি কী তাই বলেছি? অনেক কিছুই করার আছে। তবে অসুবিধা কী জানিস, সময়ের টানে ভজগ্রেড যা ভাবছে, সবটা কাজে লাগছে। আমাদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হচ্ছে না। এমন কী, জোর করে ঘটনা তৈরি করে গ্রেডবাবু মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারছে। একটা দুরূহ সমস্যা দুচোখের সামনে ভাসছে, অথচ বাধ্য হয়েই যেন আমরা সে সব সহে নিচ্ছি। অবশ্য এর মানে এই নয় যে যা চলছে, আমরা হাত গুটিয়ে মুখ বুঝে পর পর মেনে নেব। তুই রফিকের ভূমিকা নিয়ে একটু ভাবলে ভিতরের ফাঁকা অবস্থানটা বুঝতে পারবি। আগে সে ছিল একজন আদর্শমন্ডিত প্রতিবাদী যুবক। সাম্প্রতিক ভূমিকায় তার সেই অবস্থান সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কষ্ট পাচ্ছি এসব ভেবেকিন্তু কিছুই তো করার নেই। কদিন আগে সোপান-এর ঘরে বসে যেভাবে সে জিৎ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পেরেছিল, তা ভাবলেতার বর্তমান ভূমিকা ভুলে যেতে ইচ্ছে করে রে। মদ্দা কথা হল, সেই রফিক কেন নতুন করে জিৎ এর পাল্লায় পড়ল, তা নিয়ে আমাদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। তাহলে দেখবি, আরও কঠিন কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারব আমরা। এখন আমাদের কী করা উচিত সেটাই আগে বলো। অনেক কিছু করার আছে, তবে সব কিছু আলোচনা সাপেক্ষে, সকলের সম্মতি নিয়েই। আরেকটু পরে সকলে এলে পরে আলোচনা করলে একটা পথ নিশ্চয় বের হয়ে আসবে। একটা নতুন নাটক লিখতে পারো না পল্লবদা, যাতে অভিনয় করার সময় ওই সব কুচক্রীদের মুখোশ খুলে দিতে পারি। তাহলে বেশ কিছু মানুষ ভাবতে পারবে, মুষ্টিমেয় কয়েকজন কীভাবে বিদেশি শক্তির সাথে গোপন আঁতাত করে ভারতের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিতে চাচ্ছে কিংবা সম্প্রীতি নষ্ট করে কীভাবে দেশের ভিতরকার সুস্থিতি নষ্ট করতে চাচ্ছে।। তোর মধ্যেও এ ভাবনা ঢুকে পড়েছে? সেজন্যেই বলতে পারছি। তাহলে প্রশান্ত মাস্টারকে আসতে দে, দেখছি কী করা যায়। আর কী দেখবে পল্লবদা। সবাই তো গ্রুপ ছেড়ে চলে গেছে। আমরা ক’জন উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়ে আছি। একটা পুরনো কথা নতুন করে তোকে মনে করিয়ে দিই। নিজেই বলেছিলি আমরা নাটক করি সুস্থ জীবন গড়ে তুলতে, তলানিতে ঠেকে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে যেতে। তা বলেছিলাম। তাহলে এত ভেঙে পড়ছিস কেন? ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিস কেন? নিজেকে এভাবে উচ্ছিষ্ট ভাবছিস কেন? কেবল সংখ্যা দিয়ে মূল্যমান বিচার করা যায় না রে। গুণগত মানদন্ডে তা গ্রহণ করতে হয়। আসিফ গুম হয়ে বসে থাকল। তার মনের গভীরে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে— ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।’ রাত বাড়ছে পলে পলে। আসিফের বিমূঢ় মনের ইজেলে ভেসে উঠছে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়া মায়ের মুখচ্ছবি। হাঁপানির টানে যখন দম নিতে কষ্ট হয়, তখন মনে হয়, এই বুঝি জীবনদীপ নিভে গেল। গলার স্বর নামিয়ে বলল, মাস্টারের আসতে কী অনেক দেরী হবে পল্লবদা? সবে তো সন্ধে হল। এখনও সাতটা বাজে নি। আলোচনা শুরু হবে সাতটা পনেরো মিনিটে। তোর কী অন্য কোনো কাজ আছে? আসিফ চুপ করে থাকল। দুচোখ স্থির করে রাখল বাইরের অন্ধকারের দিকে। আঁধারের হাতছানি তার মধ্যে দুঃস্বপ্ন জাগিয়ে তুলছে। দ্রুত বাড়ছে সেই অনুভূতি। প্রশান্ত মাস্টার প্রবল উৎসাহ নিয়ে সোপান নাট্যসংস্থার ঘরে ঢুকলেন। পল্লবের প্রশ্ন, পথে জয়াকে দেখলে ?
আমি সাইকেলে এসেছি, ও হেঁটে আসছে। খুশি হয়ে পল্লব বলল, জয়া এলেই আলোচনা শুরু করব। আরও কিছু সময় পার হল। গরম চা এল। সকলে তাতে চুমুক দিল। বাইরে অন্ধকার বাড়ছে। ফিকে থেকেথিকথিকে হচ্ছে। আসিফ গলা চড়িয়ে বলল, দুজনেই আমাদের ঘোরতর শত্রু। ভজ-রফিকে কোনো পার্থক্য নেই। একজন জগৎ শেঠ, অন্যজন মির্জাফর। ওদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে পল্লবদা। জোরালো দাবী জানিয়ে প্রশান্ত মাস্টার বলল, সম্প্রীতির উপর একটা ভালো নাটক লেখো পল্লব। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। দেশের মানুষ জানতে পারবে উচিত অনুচিতের পার্থক্য। জয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার একটা প্রস্তাব আছে পল্লবদা। এ নাটকে এমন একটা রোল রাখো যাতে আমি নিজে দর্শকদের সামনে ভজো আর রফিকের মুখে ঝাটা মারতে পারি। পল্লব একটু হাসল। ভিতরে ভিতরে বুঝল, জয়া চলতি ঘটনার টানাপোড়েনে এত ক্ষেপে উঠেছে যে শিল্পচেতনার সেতু ধরে কঠোর বাস্তবে নামতে চাচ্ছে। সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলতে শুরু করল, যাঘটেছে বা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটবে, তাতে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। ভালো দিনের তুলনায় মানুষের জীবনে খারাপ দিনের তাৎপর্য কত বেশি, তা আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারছি। পরাজয়যেমন নতুন জয়লাভের জন্য উৎসাহ জোগায়, ঠিক তেমনি খারাপ দিন ভাবতে শেখায় নতুন দিনের জন্য। কথা দিচ্ছি, এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন নাটক লেখা শেষ করব। তারপর রিয়ার্স শুরু হবে। নতুন জনজাগরণ ঘটানোর জন্যে আমাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
সমস্বরে সকলে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ইয়া। তার পরেই শুনল, কে একজন ছুটে আসছে সোপান নাট্যসংস্থার দিকে। দুচোখ স্থির করে বাইরের অন্ধকারে চোখ রাখল সকলে। লোকটা ছুটতে ছুটতে বলতে বলতে আসছে, আসিফদা, ও আসিফদা, কোথায় তুমি? বাড়িতে বড়ো বিপদ, তোমাকে এক্ষুণি...। সবচেয়ে বেশি কম্পিত হল পল্লব। তাহলে কী? ডুকরে কেঁদে উঠল আসিফ। আসছি পল্লবদা। বলেই অন্ধকার যুঁড়ে ছুটে চলল সামনে। তার কান্নার কাতরানি ছড়িয়ে পড়ল থিকথিকে আঁধারের বুকে। পল্লব বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকল মাথা নীচু করে। কী বলে সকলকে সান্ত্বনা দেবে, ভেবে পেল না।ভিতরের ছটফটানি বাড়ছে। সহজে অনুমান করতে পারল, হাঁপানি বেড়ে গেলেও আর্থিক অনটনের জন্যে আসিফ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনে দিতে পারে নি। আলোচনার শুরুতে নিজেই ভেবেছিল, যাওয়ার সময় আসিফের হাতে দুশো টাকা তুলে দেবে যাতে সে মায়ের জন্যে ওষুধ কিনে বাড়িতে ফিরতে পারে, কিন্তু সেই সুযোগটুকু পেল না। ভাঙা গলায় বলল, চলো, আমরা সকলে হাঁটতে শুরু করি। আসিফের পাশে দাঁড়ানো খুব প্রয়োজন। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবার মন বিষাদঘন। আঁধারের বিমূঢ়তা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সকলকে। মিনিট পনেরো হাঁটার পরে সকলে পৌঁছে গেল আসিফের বাড়ির সামনে।ভিতর থেকে কান্নার রোল ভেসে আসছে। কী ভীষণ ভারী পরিবেশ। এক চিলতে বারান্দার এক কোণে বসে আসিফ কাঁদছে। একটা বড়ো নাটকের যবনিকা ঘটে গেল তার দুচোখের সামনে। এ নাটক যে আবার অভিনীত হবে, সেই সুযোগও নেই। পল্লবের মধ্যে নতুন একটা প্রসঙ্গ তিরতির করে ঢুকছে। তাহলে এভাবেই অভাবের তাড়নায় মানুষের জীবন এত সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়? সরে গিয়ে আসিফের কাঁধে হাত রাখল পল্লব। বেশ লাগছিল। সেও একই যুদ্ধে হেরে যাওয়া আর এক ক্লান্ত সৈনিক। অতীত স্মৃতির ধাক্কায় পল্লবের দুচোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। আসিফ তাৎক্ষণিক হারানোর যন্ত্রণায় অঝরে কাঁদছে, পল্লব অতীত সমুদ্রের স্রোতে ভাসছে। অন্তহীন বেদনার সাগরে, যন্ত্রণার আঘাতে এবং ব্যর্থতার ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে দুজনের দুঃখী মন এক বিন্দুতে মিলিত হল।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আসিফ বলল, দেশের মা অনেক বড়ো, নাটক লেখা দ্রুত শেষ করো পল্লবদা। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না পল্লব। অবোধ শিশুর মতো ডুকরে কেঁদে উঠল। জয়াও কাদছে। ছন্দপতনের অন্ধকারে দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকল সকলে। পল্লবের গুরু, জীবনের দরবেশ রহমান কোথা থেকে খবর পেয়ে চলে এসেছেন আসিফের বাড়িতে। হাঁটু পর্যন্ত পাঞ্জাবী। মাথায় সাদা টুপি আর রবীন্দ্রনাথ সদৃশ্য ভরাট দাড়ি। অর্ধেক পাকা, অর্ধেক কাচা। বেশ লাগছিল তাকে। গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন, এভাবে ভেঙে পড়োনা পল্লব, বিপদের সময় পাথরের মতো শক্ত হতে হয়। গুরুর অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ। অমান্য করতে পারল না পল্লব। উঠে দাঁড়াল ধীরে ধীরে। চাপা স্বরে রহমানের আশিস বাণী, কেঁদে আসিফকে হাল্কা হতে দাও পল্লব। বিদ্যুৎ সংযোগ তখনও শুরু হয় নি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুহেলি পাখির ডাক ভেসে আসছে কানে। চোখ গেল পাখি ডাকছে। সকলে হাঁটতে শুরু করল সোপান নাট্যসংস্থার উদ্দেশ্যে। মাঝপথে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন রহমান। পল্লবের কাঁধে হাত রেখে বললেন, মনে রেখো, অন্ধকারের শেষ যাত্রা শুধুই আলোর দিকে, যেজন্যে রাত শেষ হলে নতুন সকাল আসে, সাত রঙের আলোয় ভরে ওঠে পূবের আকাশ।নাট্য বিপ্লবের ক্ষেত্রে তা সমানভাবে সত্যি। জাতীয় চেতনাও একই প্রতীকির উপর দাঁড়িয়ে। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে নতুন আলোর ঝলকানি, তাতেই জীবন, সমাজ, জাতীয় ভাবনা নতুন করে গড়ে ওঠে। খাঁটি বিপ্লবের শেষ কথা সেখানেই। তুমিও সেই দায়িত্ব অনেকখানি পালন করতে পেরেছ। আরও মনে রেখো, কয়েকজনের বিশ্বাসঘাতকতায় কোনো বিপ্লব থেমে থাকে না। বিপ্লবের বীজরয়েছে মানুষের চেতনায়, তা সামনে আনার দায়িত্ব দেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের। ইতিহাস মনে রাখবে তাদের, যারা লড়ে সুস্থ জীবনের জন্যে, মানুষের জন্যে, ইতিহাস মনে রাখবে তাদের, যারা মুক্তির বীজ বোনে হৃদয়ে হৃদয়ে, কালরাত্রি সাঁতরে নিয়ে আসে রক্ত গোলাপ, ইতিহাস মনে রাখবে তাদের, যারা তাদের একটিমাত্র জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীনতার জন্যে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নতুন আশাবরির সুরে সকলে কম্পিত হতে থাকল। রহমানের হৃদয় ছুঁয়ে এক নতুন ভারতের স্বপ্ন দ্রুত গতিতে মনের ইজেলে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আঁধারের আশাবরি বড়োনির্মম, নির্দয় কিন্তু তবুও তার নিষ্ঠুর বাস্তবতা বারবার পল্লবকে কম্পিত করতে থাকল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct