জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ছাত্রবৃত্তি পাবে এবার হিন্দু পড়ুয়ারাও, পেটে পাথর বেঁধে হলেও সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে: মাওলানা আরশাদ মাদানি
আপনজন ডেস্ক: দেশের অন্যতম শীর্ষ মুসলিম সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এ বছর এক কোটি টাকা ছাত্রবৃত্তি দেবে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ডিগ্রি কোর্স করার জন্য মুসলিম পড়ুয়অদের পাশাপাশি হিন্দু পড়ুয়াদেরও দেওয়া হবে এই বৃত্থি। তাই তারাও বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারেন। দিল্লিতে সূচনা অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা করেছেন জমিয়তের সভাপতি মাওলানা সৈয়দ আরশাদ মাদানি। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, মুসলিমদের এখন এমন সময় এসেছে যে তারা নিজ পেটে পাথর বেঁধে হলেও সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে। এখন আমাদের এমন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন, যেখানে আমাদের সন্তানরা নির্বিঘ্নে, নিঃসংকোচে, বিনা বাধায় জাগতিক শিক্ষার উঁচু শিখরে আরোহণ করবে। মুসলিম ধনী ব্যক্তিদের উচিত ছেলে-মেয়েদের জন্য বেশি বেশি এমন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে আমাদের সন্তানরা ধর্মীয় পরিবেশে সহজেই জাগতিক শিক্ষা অর্জন করবে।
উল্লেখ্য, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ২০১২ সাল থেকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের মেধাকে মেধা ভিত্তিক বৃত্তি প্রদান করে চলেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, শিক্ষা গত এবং সাংবাদিকতা কোর্স ের শিক্ষার্থীদের এই বৃত্তি দেওয়া হয় যারা তাদের যোগ্যতা অর্জন পরীক্ষায় কমপক্ষে ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। ২০২১-২২ সালের বৃত্তি জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২। বস্তুত, গত শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন কোর্সে নির্বাচিত ৬৫৬ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কিছু হিন্দু ছাত্রও রয়েছেন। জময়িতে উলামায়ে হিন্দের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বছর বৃত্তি দেওয়অর পরিমাণ বাড়িয়ে মোট এক কোটি টাকার করা হয়েছে। আগামী বছরগুলিতে পরিমাণ আরও বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে সংগঠনের সদর দফতরে শিক্ষাবৃত্তির ঘোষণা অনুষ্ঠানে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা সৈয়দ আরশাদ মাদানি বলেন, আমরা এই বৃত্তি ঘোষণা করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত যে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় এই ধরনের অনেক যোগ্য ও পরিশ্রমী শিশুর ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও গড়ে উঠতে পারে। যারা তাদের আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের শিক্ষা চালিয়ে যেতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা এর ফল পেতে পারেন। সেই তিনি বলেন, বিশেষত মুসলিমদের এখন এমন সময় এসেছে যে তারা নিজ পেটে পাথর বেঁধে হলেও সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে। এখন আমাদের এমন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন, যেখানে আমাদের সন্তানরা নির্বিঘ্নে, নিঃসংকোচে, বিনা বাধায় জাগতিক শিক্ষার উঁচু শিখরে আরোহণ করবে। তিনি বলেন, মুসলিম ধনী ব্যক্তিদের উচিত ছেলে-মেয়েদের জন্য বেশি বেশি এমন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে আমাদের সন্তানরা ধর্মীয় পরিবেশে সহজেই জাগতিক শিক্ষা অর্জন করবে।এ সময় জাগতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়কারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, আর্থিক সমস্যার কারণে যারা লেখাপড়া চালু রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল বা বন্ধ করতে চলেছিল তাদের মত অনেক মেধাবী ও মেহনতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হচ্ছে আমাদের এই ছোট্ট প্রচেষ্টায়।
আরশাদ মাদানির মূল্যায়ণ, সারা দেশে যে ধর্মীয় ও আদর্শিক যুদ্ধের সূচনা হয়েছে, কোনো হাতিয়ার, অস্ত্র বা টেকনোলজির ব্যবহারে এর মোকাবেলা সম্ভব নয়। বরং এই যুদ্ধে জেতার একমাত্র রাস্তা হল আমাদের আগামী প্রজন্মকে এমনভাবে উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলা, যাতে তারা নিজেদের শিক্ষা, আদর্শ ও চিন্তা-চেতনার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে তছনছ করে নিঃশেষ করে দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যেন আমাদের সন্তানেরা সফলতার ওিই স্থরে পৌঁছতে পারে, যেখানে পৌঁছানো আমাদের জন্য রাজনৈতিক বেড়াজালের কারণে দুঃসাধ্য, অসম্ভবপ্রায়। তিনি দাবি করেন, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত যারাই ক্ষমতায় এসেছে কুপরিকল্পনা মাফিক মুসলিমদের শিক্ষাঅধিকার বঞ্চিত রেখেছে। সচেতন নাগরিক কমিটির এক অনুসন্ধানে এর প্রমাণ মিলেছে। যেখানে স্পষ্ট ভাষায় লেখা রয়েছে, শিক্ষায় মুসলিম জনগোষ্ঠী ভারতের ছিন্নমূল, নিপীড়িত ও অনগ্রসর জাতি ‘দলিত সম্প্রদায়’-এর চেয়েও অনেক পিছিয়ে রয়েছে।তিনি বলেন, আপনাদের কি মনে হয় এসব এমনি-এমনিতেই হয়েছে বা মুসলিমরা নিজ ইচ্ছায় শিক্ষা থেকে দূরে রয়েছে? কখনো নয়, বরং ক্ষমতায় আসা প্রতিটি সরকারই আমাদেরকে শিক্ষাগত অনগ্রসরতা আর পশ্চাৎপদতার শিকার বানিয়েছেন। হয়তো তারা বুঝেছিল, যদি মুসলমান শিক্ষার ময়দানে অবতীর্ণ হয় তাহলে নিজ যোগ্যতা, সামর্থ্য ও ন্যায্যতার বলে দেশের সকল উচ্চ পদ তারা দখল করে নিবে। তাই বিভিন্ন ধরনের টালবাহানা, ছলচাতুরি, অজুহাত ও মিথ্যে সমস্যা তৈরি করে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তর থেকে মৌলিকভাবে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা চালানো হয়েছে।
নিজেদের বিয়ে-শাদী, রাজনৈতিক ও আনন্দের অনুষ্ঠানে বিশাল অঙ্কের যেই টাকা-পয়সা অপচয় করে, সন্তানকে শিক্ষা দেওয়া ফরজ মনে করে সেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে ব্যয় করা। আমাদের সমাজে হাফেজ, আলেম ও মুফতির সাথে সাথে প্রফেসর, ডাক্তার ও ইন্জিনিয়ারের প্রয়োজনও অপরিহার্য। তবে অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হল, বর্তমানে আমাদের যে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার, সে বিষয়ে মুসলিমরা অনেকটাই উদাসীন। তার আফসোসা, মুসলমানরা বিভিন্ন কাজে দুহাত খুলে খরচ করলেও শিক্ষা বিষয়ে তাদের কোনো গুরুত্ব নেই। এটা আমাদের মগজে ভালোভাবে ঢুকিয়ে নেওয়া দরকার যে, বর্তমান এই করুণ পরিস্থিতির মোকাবেলা শুধুমাত্র শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমেই সম্ভব। এজন্য আমরা জাগতিক শিক্ষার উন্নয়নে দেওবন্দ এলাকায় বি এড কলেজ, ডিগ্রী কলেজ, ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক পৃথক স্কুলের মতো কয়েকটা উন্নতমানের প্রতিষ্ঠান খুলেছি। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রদেশে আই টি আই প্রতিষ্ঠান খুলেছি, যার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ইতিমধ্যে প্রকাশও পেয়েছে।
মাদানী বলেন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কার্যক্রম অনেক বিস্তৃত। প্রতিটি ময়দানে সফলতার সাথে কাজ করছে। একদিকে যেমন ধর্মের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করছে, অন্যদিকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দিচ্ছে যেগুলো জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়। যাতে মুসলিম সন্তানরা এসব শিক্ষা সমাপ্ত করতেই চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যায়। আর হীনমন্যতা ও হতাশার শিকার হয়ে নিজের প্রতিভা ও যোগ্যতার বলিদান না করে।
মনে রাখবেন, আমাদের সন্তানরা মেধা, যোগ্যতা ও চেষ্টায় অন্যদের থেকে পিছিয়ে নেই। সমসাময়িক কিছু অনুসন্ধানের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে মুসলিম শিক্ষার্থীদের মাঝে শুধু শিক্ষার অনুপাত বাড়েনি বরং তাদের মাঝে শিক্ষার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে ব্যাপক হারে। তাই আমাদের আফসোস করার প্রয়োজন নেই বরং তাদের উৎসাহ দিয়ে মেহনতি বানানো দরকার, যাতে উন্নয়নের পথে আসা সকল বাঁধা অতিক্রম করে ছিনিয়ে আনতে পারে নিজেদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে কাঙ্ক্ষিত সফলতা। আমরা মানবতার ইতিহাসে এমন অনেক জাতির সন্ধান পাই, যারা আদর্শ, শিক্ষা ও জ্ঞান-গরিমায় সারা বিশ্বে অন্যতম ছিল। তবে প্রত্যেকটি জাতিই তাদের সফলতার ইতিহাস নিজেরা লিখেছে। সুতরাং মুসলিমদের সফলতার ইতিহাসও আমাদের নিজ হাতে লিখতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘মাদানী হান্ড্রেড কোচিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার পিছনেও এই উদ্দেশ্য ছিল। যার তত্ত্বাবধানে আর্থিকভাবে দূর্বল মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিনা খরচে ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারবে। উল্লেখ্য, ২০১২ সাল থেকে আজ অবধি ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও এম এইচ এ মাদানী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দেওবন্দ’-এর সমন্বয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্বাচিত গরিব শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অনুপাতে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে।অবশেষে তিনি বলেন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের শাখা ‘আরশাদ মাদানী গণশিক্ষা সহায়তা ফান্ড’ সর্বদা মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে রয়েছে। দেশের উন্নয়ন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে সর্বদায় দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে আমরা এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, প্রতিটি শহরে-বন্দরে এমন স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টার খোলা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঘরের কোণে বসে কোনো বিপ্লব সৃষ্টি করা যায় না বরং বিপ্লবের জন্য আপ্রাণ চেষ্টার সাথে সাথে কুরবানী ও ত্যাগের খুবই প্রয়োজন। এছাড়াও এম এইচ এ মাদানী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দেওবন্দ ও হিন্দু গুরুএকাডেমি জামিয়ানগর দিল্লির পারস্পরিক সহযোগিতায় একটি কোচিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন জমিয়ত সভাপতি। যার তত্ত্বাবধানে আর্থিকভাবে দূর্বল মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিনা খরচে ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়। এসব কার্যক্রম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ধর্ম ভিত্তিক কাজের সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। এ বছরের শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদনের তারিখ ২০শে জানুয়ারি থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। অনলাইন ও অফলাইন উভয় পদ্ধতিতে আবেদন করা যাবে।
আরও পড়ুন: