ফৈয়াজ আহমেদ : সাধারনত আমাদের ‘জেলখানা’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একের পর এক সারিবাঁধা ছোট ছোট ঘুপচি ঘর। সামনে তার লম্বা লোহার গরাদ আর সেই গরাদের ফাঁকা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অসহায় কিছু মানুষের মুখ। যাদের মধ্যে আছে ভয়ংকর সব সন্ত্রাসীরাও। নিরানন্দ আর কুৎসিত এক জায়গা। যেখানে কারোই যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু এসব তো সাধারণ জেলখানার গল্প। এবার যে জেলখানাগুলোর গল্প বলবো আপনাদেরকে সেগুলো এই স্বাভাবিক আর সাধ্রন আর দশটা জেলখানার চাইতে একেবারেই আলাদা। কীভাবে? চলুন না জেনে আসি।
১. সেবু প্রভিন্সিয়াল ডিটেনশন এন্ড রিহেবিলিটেশন সেন্টার
মনে আছে ২০০৭ সালের কথা? হুট করে একটি জেলে ধারণ করা নাচের ভিডিও প্রচুর সাড়া ফেলে দিয়েছিল পুরো বিশ্বজুড়ে। বলছিলাম ফিলিপাইনের জেল সেবুর কথা। নিজেদের শরীরচর্চার সময় নাচের চর্চা করে একটা সময় মাইকেল জ্যাকসনের ‘থ্রিলার’ গানের সাথে পা মেলায় এই জেলের কয়েদীরা। মোট ১,৫০০ জন মানুষ একসাথে এক তালে নেচে ওঠে। এই জেলের কয়েদীদের কাছে নাচ যেন খুব ভালোলাগা ও ভালোবাসার কোনো বিষয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে মাইকেল জ্যাকসনের কোরিওগ্রাফার চলে আসেন জেলে শুধু এই মানুষগুলোকে নাচ শেখাতে। ভাবুন তো, একটা পুরোদস্তুর জেলে এমন কান্ড ঘটে গেলো! তার মধ্যে কয়েদীরা গোমড়ামুখে বসে না থেকে বা মারামারি না করে নাচ শিখছে, নাচছে আর নাচের কলাকৌশল আয়ত্ব করার চেষ্টা করছে। সত্যিই, আর সব জেলের চাইতে একটু বেশিই আলাদা ফিলিপাইনের এই জেলটি।
২. বাস্টোয়ি দ্বীপ
নরওয়েতে জেল বলতে সেই অর্থে জেলখানাকে বোঝায় না। বোঝাবেই বা কীভাবে! এখানে না আছে যাবজ্জীবন, না আছে মৃত্যুদণ্ড। তাই যত গুরুতর অপরাধই করুক না কেন অপরাধী, একদিন তাকে বাড়িতেই ফিরে যেতে হবে- এটা সবার জানা। ফলে এখানকার জেলগুলোও একটু অন্যরকম আর সব দেশের চাইতে। বিশেষ করে বাস্টোয়ি দ্বীপের জেলের কথা তো না বললেই নয়। এই দ্বীপে আপনি যেমন জেল চেনেন সেরকম কিছুই খুঁজে পাবেন না। কারণ, এখানে জেল বলতে বোঝায় অনেকটা ছুটি কাটাতে আসার মতো। যে জেলের চাবি থাকে জেলের কয়েদীদের কাছেই। এমনকি জেলে নেই কোনো ছোট্ট ঘর কিংবা লোহার গরাদও। সময় কাটানোর জন্য খামার আছে, যেখানে কয়েদীরা ইচ্ছে করলে গরু-ছাগল চরাতে পারেন। শাস্তির সময় শেষ হয়ে আসলে এই হলিডে হোম ছেড়ে নিজেদের বাড়ি ফিরে যায় প্রত্যেক কয়েদী।
৩. সান পেদ্রো জেল
বলিভিয়ার লা পাজের ঠিক পাশেই অবস্থিত সান পেদ্রো জেল। তবে একে জেল না বলে বরং কোনো ক্ষুদ্র একটি শহর বলা চলে। কী নেই এখানে? জেলের ভেতরে হোটেল, নাপিত, খাবার স্থান- ভাবা যায়! তবে এই অদ্ভুত ভাবনাকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে বলিভিয়ার এই জেলখানাটি। এখানে ইচ্ছা করলেই কয়েদীর সাথে দেখা করতে গিয়ে কয়েকটা রাত কাটিয়ে আসা যায়। তবে এর কোনোটাই কিন্তু বিনা খরচে হয় না। বেশ ভালো পরিমাণ টাকা প্রদান করতে হয় এই জেলের দোকান কিংবা অন্যসব স্থানে সেবা পাওয়া জন্য।
এমনকি যে গরাদের মধ্যে থাকতে দেওয়া হয় কয়েদীদের সেটার জন্যেও টাকা খরচ করতে হয় তাদের। প্রতিটি জেলখানার ঘরের পেছনে খরচ পড়ে ১,০০০ থেকে ১,৫০০ ডলার পর্যন্ত। কারো কাছে টাকা থাকলে আলিশানে জেলের মধ্যে সময় কাটানোটা কোনো ব্যাপারই নয়। টেলিভিশন, এসি আর সমস্ত ভালো ভালো সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় এখানে টাকার বিনিময়েই। কারো কাছে যদি টাকা না থাকে সেটাও কোনো সমস্যা নয়। জেলের মধ্যে কাজ করার মাধ্যমে টাকা আয় করে সেই টাকা দিয়ে নিজের থাকার ঘরকে উন্নত করার সুযোগ থাকে এখানে কয়েদীদের হাতে।
৪. সান অ্যান্তোনিও জেল
ভেনিজুয়েলার মার্গারিটা দ্বীপে অবস্থিত এই জেলে কয়েদীরা ঠিক যেন মুক্ত, স্বাধীন মানুষের মতোই বসবাস করে। নিজেদের খাবার নিজেদেরকেই রান্না করে নিতে হয় তাদের। সেইসাথে আছে টেলিভিশনে নানারকম অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ। তবে সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো, জেলে বসেও তারা নিজেদের মতো কাজ চালিয়ে যেতে পারে। জেলের ভেতরেও বিভিন্ন রকম কাজ খুঁজে নিতে পারে তারা। এর মধ্যে আছে জুতো সেলাই করা কিংবা মাদক চোরাচালানের কাজ।
আছে জেলের মধ্যে হওয়া মোরগ লড়াইয়ের ব্যবস্থাপকের কাজ। এই সবকিছুই করতে পারে কয়েদীরা এবং সেটা সবার চোখের সামনেই। নিজেদের এই কাজের মাধ্যমে ভালো আয়ও করে তারা। সান আন্তোনিও জেলে যে কেবল কয়েদীরাই থাকে তা কিন্তু নয়। ইচ্ছে করলে বাইরের কোনো মানুষও গিয়ে কয়েদীদের সাথে তাদের উৎসব, তাদের আনন্দে যোগ দিতে পারে। হতে পারে সেটা কোনো এক রাতের পার্টি! বন্ধুদের সাথে উপভোগ করার জন্য জেলের চাইতে ভালো কোনো স্থানই যেন হয় না!
৫. ফোরটেজ্জা মেডিচা জেল
কখনো ইচ্ছা হলো কোনো জেলে গিয়ে, সেই জেলের কয়েদীদের হাতের খাবার খেতে, তাহলে কেমন হবে? ফোরটেজ্জা মেডিচা ঠিক এমনই এক জেল। মধ্যযুগে নির্মিত এই জেলটিতে বর্তমানে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছে অনেক ভয়ংকর আসামী। তবে তাদের সবাই এখন খুন কিংবা কোনো মারাত্মক চিন্তা ভাবনা নয়, বরং কী রান্না হবে সেই চিন্তায় মগ্ন থাকে। টাস্কানির ভল্টেরার এই জেলে বর্তমানে বাস করছে মোট ১৫০ জন আসামী। শুধু তা-ই নয়, তাদের মাথার উপরে বেশ বড় ধরনের দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। আর সেই দায়িত্বটি হল মানুষকে খাবার খাওয়ানো। পৃথিবীর অন্যতম বিশেষ একটি রেস্টুরেন্ট চালায় এই জেলটি। যেখানে রান্না করা থেকে খাবার পরিবেশন পর্যন্ত সবকিছু করে থাকে কয়েকজন আসামী।
এদের মধ্যে আছে খুনী থেকে শুরু করে সন্ত্রাসীরাও রয়েছে। ইচ্ছা হলে আপনিও এই রেস্টুরেন্টে ঘুরে আসতে পারেন। ভাবছেন, যদি কেউ আপনাকে আক্রমণ করে বসে? না সেটা সম্ভব নয়। কয়েদীরা যাতে কারো উপর আক্রমণ না করে এবং নিজেদের মধ্যেও সমস্যা তৈরি না করতে পারে সেজন্য সবসময় কড়া নজর রাখা হয় তাদের উপর। তাছাড়া রেস্টুরেন্টের সমস্ত জিনিসপত্র হলো প্লাস্টিকের। ফলে আক্রমণ করলেও সেটা খুব একটা ফলপ্রসূ হওয়ার কথা নয়!
৬. জাস্টিজএন্ট্রুম লিওবেন জেল
‘জেলটির বাইরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং ভেতরে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে’। নিজের হাতে গড়ে তোলা জাস্টিজ এন্ট্রুম লিওবেন জেল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছিলেন স্থপতি জোসেফ হোহ্যান্সিন। বাস্তবেও অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত জাস্টিজ এন্ট্রুম লিওবেন জেলের বাইরে থেকে দেখলে আপনার বিশ্বাস হতে চাইবে না যে এটা কোনো জেল। মন ভালো করে দেওয়া কাঁচ এবং কাঠের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে পুরো জেলের বাইরের অংশ। যেন কোনো বিশাল কলেজের ডর্মেটরি। আর ভেতরে? ভেতরটাও এমনটাই মন ভালো করে দেওয়া আর বিশাল বলে জানান প্রকৌশলী। তবে তাই বলে বাইরের নিরাপত্তাটুকুও দেখা হয়েছে জেলটিতে। কী ভাবছেন, ঘুরে আসবেন নাকি একবার অস্ট্রিয়ায়েই বিলাসবহুল জেল থেকে?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct