সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১১ কিস্তি ২
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
কৌতুহল বাড়তে লাগল পল্লবের। আসিফকে বলল, তুই সাইকেলে গিয়ে জয়াকে এক্ষুণি ধরে নিয়ে আয়। ওর মাধ্যমে আরেকটা নতুন সূত্র পেয়ে যেতে পারি। নানা ধরণের সন্দেহ জাগছে মনে। হয়তো তুই ঠিকমতো জানিস নে, ওই স্যারের বাবা জুলফিকার হাসান ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। দেশের জন্যে তাকে পাঁচ পাঁচ বার জেলে যেতে হয়েছিল। সেই বাবার ছেলে হিসেবে ফারুক স্যারের পক্ষে কী এ কাজ করা সম্ভব? প্রতি বছর ১৫ আগষ্ট নিজের উদ্যোগে টানা তিন দিন জাতীয় ভাবনার উপর নানা ধরণের অনুষ্ঠান করে থাকেন। তার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব হল কী করে? সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। একটা ভাবনার সাথে আরেকটা ভাবনা কিছুতেই মিলছে না। ফ্যানটাসটিকসকে নতুন করে বাজারে আনার জন্যে পিংপং ভজকে দিয়ে নতুন প্লট তৈরি করে এসব করছেন না তো? রহমানকাকুকী বাড়িতে আছেন? গত পরশু দিন ফেরার কথা। উত্তর প্রদেশ যাওয়ার দিন আমাকে তাই বলে গিয়েছিলেন, তাহলে তুই সাইকেলে জয়ার বাড়িতে যা, আমি কাউকে দিয়ে রহমান কাকুর ফিরে আসার ব্যাপারটা জেনে নিই।
আসিফ চলে গেল জয়াকে ধরে আনতে। পল্লব একা রিয়ার্স রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে। জানালার রড ধরে দূর আকাশের দিকে চেয়ে থাকল। একটু আগে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়েছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্যাঁচার কর্কশ শব্দ ভেসে আসছে কানে। তাতেই সমগ্র পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। আবেগতাড়িত পল্লব পেলব বাস্তবস্মৃতির গভীরে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকল। অতীতের বিশেষ কয়েকটিমুহূর্ত তার মনের ইজেলে রঙিন হয়ে উঠেছে।
বছর বারো বয়সে এক অদ্ভুত অসুস্থতা গ্রাস করেছিল তাকে। ডাক্তার দেখানোর পরেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল না। শেষে ভর্তি করা হয়েছিল স্থানীয় হাসপাতালে। সুপার অভিক সরকার এসে বললেন, এখনিই প্রস্রাব, পায়খানা, রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। দুদিনের মধ্যে সেই পর্ব শেষ হয়েছিল। রিপোর্ট দেখে অভিক সরকার বললেন, ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্যে ও-নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন কিন্তু হাসপাতালের স্টকেছিল না।সংগ্রহ করে আনতে পারলে চিকিৎসা করা সম্ভব, নতুবা...।
তখনও পল্লব বিছানার উপর নেতিয়ে শুয়েছিল। ভিতরের যন্ত্রণা বাড়ছে। শ্বাসকষ্টে টানা শুরু হয়েছে। পশ্চিমের সূর্য ডুবে যাচ্ছে দূরের মাঠে। ও-নেগেটিভ রক্ত সংগ্রহ করা নিয়ে মানসিক উদ্বেগ বাড়ছে তর তর করে। একটু পরে সন্ধ্যার কালো ছায়া নামল হাসপাতালের সামনের চত্বরে। মা কেঁদে চলেছে বেডের পাশে বসে। অন্যান্য আত্মীয় পরিজনরাও ইতস্তত ভাবনায় ডুবে ছিল। নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত পাওয়া না গেলে কী হবে, সেই ভাবনায় সকলে দুলছে। যেন আর কোনো অবলম্বন নেই। চরম হতাশার গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে সকলে। সন্ধের আকাশে কালো মেঘের বিস্তার। তা থেকে যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।
বিশ্রি গুমোট পরিবেশ। সকলের বুকে তা চেপে বসেছে কয়েক কুইন্টাল ভারী পাথর হয়ে। হঠাৎ এক অপরিচিত লোক বেডের পাশে এসে দাঁড়ালেন। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উচ্চতায় প্রায় ছ’ফুট। সুঠাম শারীরিক গঠন। ফর্সা মুখশ্রীতে অস্বাভাবিক ভাবগম্ভীরতা, জানতে চাইলেন, ডাক্তারবাবু কই?
কে বাবা তুমি? কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করল পল্লবের মা।। আমি ছেলেটার জন্যে ও-নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত এনেছি।
একটা অজানা ভরসায় মায়ের দুচোখ ছলছল করে উঠল। সুপার অভিক সরকার ফিরে এসে জানতে চাইলেন, তাহলে আপনারা কী সিদ্ধান্ত নিলেন ?
আমি ছেলেটার জন্যে রক্ত দিতে এসেছি ডাক্তারবাবু। আগুন্তুকের কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়।
অভিক সরকার ধমকে উঠলেন, জানো কী ওর জন্যে কোন গ্রুপের রক্ত লাগবে?
জেনে এসেছি ডাক্তারবাবু।
তোমার শরীরে কী ও-নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত আছে?
আগন্তুক পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে অভিক সরকারের হাতে দিয়ে বললেন, দেখুন ডাক্তারবাবু। ছ’মাস আগে উত্তরপ্রদেশে রক্ত দিয়েছিলাম, তার বর্ণনা আছে এই কার্ডে।
অভিকসরকার নতুন সন্দেহে দুলতে লাগলেন। ভদ্রলোক তো দিব্যি বাংলায় কথা বলছেন। উচ্চারণ খাঁটি বাঙালির মতো। তাহলে উত্তরপ্রদেশে রক্ত দিলেন কী করে? প্রশ্ন করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়?
অসুস্থ ছেলেটির পাশের গ্রামে। লাগালাগি দুটো গ্রাম।
তাহলে উত্তরপ্রদেশে রক্ত দিলেন কী করে?
সে অনেক কথা ডাক্তরবাবু। আগে বলুন, আমার দেখানো কাগজটা নকল কিনা। যদি না হয়ে থাকে, এখনিই ছেলেটাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করুন। পাশের বেডে শুয়ে পড়ছি, যতটা রক্ত লাগে নিন। কেবল ওকে বাঁচিয়ে তুলুন।
অন্য কিছু ভাবার সময় ছিল না ডাক্তারবাবুর। রক্ত নেওয়ার পর্ব সেরে ফেলার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। চলল প্রায় এক ঘন্টা ধরে। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে তখন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেছি। একসময় চোখের পাতা খুলেদেখি, ডাক্তারবাবু নাড়ি ধরে আমার বেডের পাশে চুপচাপ বসে আছেন। একটু পরে স্মিত হেসে বললেন, খারাপ সময় প্রায় কেটে গেছে। আর ভয়ের কোনো কারণ নেই।।
আরও কিছু সময় পার হল। সুপার অভিক সরকার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভদ্রলোকের জন্যে ছেলেটা এ যাত্রায় বেঁচে গেল।।
এই লোকটাই পরবর্তী সময়ে তার জীবনে গুরুর ভূমিকায় দেখা দিয়েছিল। সব কাজের সুপরামর্শদাতা। আজও মর্মে মর্মে সে তা অনুভব করতে পারে। জটিল কোনো সমস্যা দেখা দিলে তার দেখানো পথে বার বার জিতে গেছে। তবে লোকটার স্বভাবে একটা মস্ত বড়ো ত্রুটি রয়েছে। একেবারে সংসার বিবাগী মানুষ। গ্রামেই থাকেন না। নতুন প্রজন্মের ছেলেরা তাকে চেনে না বললেই চলে। ভারতের রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোই তার মূল কাজ। অনেকবার তাকে বলেছেন, আমার ধর্ম আমার জন্য, তোমার ধর্ম তোমার জন্য— এটাই ধর্মবোধের মূল কথা। এ বাণী সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। নাহলে যে ভারত দুর্বল হয়ে পড়বে।
পল্লব তখনও ভেবে পায় নি, একটা লোক পদার্থবিদ্যায় এম এস সি প্রথম শ্রেণি পাওয়ার পরে চাকরী বাকরী না করে সারা বছর ধরে কীভাবে এত নিষ্ঠার সাথে ভারত-সাধনা করে যেতে পারেন। বিশ্ব সম্প্রীতির সব রসায়ন নিয়েই তার আত্মিকতা গড়ে উঠেছে বলেই এভাবে একশো কোটির ভারতকে নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ানোর সাহস দেখাতে পারেন। অনেক দিন পর পর বাড়িতে ফেরেন।রাস্তার মাঝে দেখা হলে মুখে মৃদুহাসি টেনে হয়তো বললেন, কেমন আছ পল্লব? আম-মানুষের কাছে নাটক নিয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছ তো? সম্প্রীতির ভাবনা তোমার নাটকে থাকছে তো? পারলে আরও বেশি করে সম্প্রীতি আর দেশপ্রেমের ভাবনা তোমার নাটকে ঢুকিয়ে দিও। জানো পল্লব, নিজের দেশকে বড়ো করে তুলতে গেলে কেবল এই ভাবনায় ডুবে থাকতে হবে। এটাই জীবনের একটা বিশেষ সাধনা।
প্রত্যেকবার একই উত্তর দিয়ে বলেছি, সেই মূল্যবোধ ধরে রাখার চেষ্টা করছি কাকু।
ভারতকে বেশ বুঝতে শিখেছো পল্লব। মনে রেখো, আজও ভারতের কিছু মানুষ ইংরেজদের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা পোষণ করে। এ যে জীবনের কত বড়োগোলামি, তা তারা জানে না। নাটকে দেশপ্রেম বাড়লে এ ভীরুতা কেটে যাবে অদুর ভবিষ্যতে।।
ভাবে গদগদ হয়ে বললাম, কাকু, বাড়িতে চলুন। আপনাকে নিয়ে আসিফ যখন তখন আমাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। যতটা পারি, উত্তর দিই। কদিন আগে ওর মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখেই মাসিমা বলল, তোমার ভারতকে একবার দেখাতে পারো না পল্লব?।
কার কথা বলছেন মাসিমা? ভারত তো আমাদের দেশের নাম।
দূর বোকা ছেলে। এত কম বুঝলে চলে? আসিফ রোজ এসে বলে, পল্লবদার গুরুকে আমি মনে মনে ভারতকাকু বলে ডাকি। এজন্যে লোকটাকে খুব দেখার ইচ্ছে হয়।
ভাবনার গতি পথে হাঁপিয়ে উঠল পল্লব। একটা বিদায়ী দৃশ্যের কথা খুব করে মনে পড়ল তার। সেদিনও অনুরোধ করে সে বলেছিল, কাকু শুনুন, আসিফের মাকে একদিন দেখতে গেলে ভালো হয়।
হন্হন্ পায়ে সামনে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। ভারত পথিক রহমান আজ বিকেলে মধ্যপ্রদেশের উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরতে হবে তাকে। সম্প্রীতির উপর একটা বড়ো আলোচনা আছে। বক্তব্য রাখতে হবে সেখানে। সভার শেষে ট্যাবলো বের হয়ে রাজপথ পরিক্রমা করবে। সেই মিছিলেও থাকতে হবে।
এভাবেই ভারতকাকু গুরুর ভমিকা নিয়ে তাকে বার বার রাঙিয়ে দিয়েছেন। নতুন নাটক লেখার সময়, নির্দেশনা দেওয়ার সময়, আম-মানুষের সাথে মেলামেশা করার সময় নতুন ভাবনা এলেই পল্লবের মনের ইজেলে ভেসে ওঠে প্রিয় গুরুর বড়ো কাট-আউট। লোকটা শুধু তাঁর জীবনরক্ষক নয়, খাঁটি ভারত সাধক! সম্প্রীতির প্রয়োজনে রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় একখণ্ড প্রিন্টেড রঙিন কাগজ পকেটে রাখেন। ল্যামিনেশন করা। যাতে সহজে নষ্ট না হয়, তার জন্যে এমনি ব্যবস্থা।তাতে উজ্জ্বল করে লেখা ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’। দেখিয়ে যাকে তাকে বলেন, এটাই ভারতের সমুন্নতি রক্ষার মূল রসায়ন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct