প্রাক্তন
শংকর সাহা
_____________
অফিসের তিনদিন ছুটি পড়ায় গৌড় এক্সপেস ধরার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে দীব্যজ্যোতি। মাস খানেক পরে আজ তার বাড়ি ফেরার পালা। ব্যাগে বাড়ির জন্যে কেজি দুয়েক আমও সে নিয়েছে। রির্জাভেশন টিকিট থাকায় তেমন কোনো চাপ ছিলনা তার। কামরায় ওঠেই জানালার পাশে গিয়ে বসল দীব্যজ্যোতি। “আজ গরমটাও পড়েছে”-বলে পেপারের অংশটুকু নিয়ে স্বস্তির বাতাস করতে থাকে সে। জানালার পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ব্যাগের চেন খুলে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ মুখ গুজে পড়তে থাকে সে। কানে হেডফোন। বইয়ের পাতাটি উল্টোতেই দীব্য হঠাত বুঝতে পারে কে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে রীতিমতো অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। আসলে বরাবর সে মেয়েদের থেকে একটু দূরেই থেকেছে। হঠাত তার দিকে হেসে বছর পঁচিশের একজন বলল, “ আপনি রবি ঠাকুরের ফ্যান বুঝি?” হুম! বলে মাথা নোয়ালো দীব্য। “ আচ্ছা, আপনি ‘গল্পগুচ্ছে’র সবগুলো গল্প পড়েছেন? কোন গল্পগুলো ভালো লেগেছে আপনার ?” দীব্য রীতিমতো বিরক্তিকরভাবে বললো, “ সময়ের অভাবে সবগুলো পড়া হয়ে ওঠেনি। আশা রাখছি পড়বো। “ বলেই সে মুখটি জানালার দিকে করে বিড়বিড় করে বলে, “ ওনি এতো শুনে কি করবেন?” হঠাতই সে বলে, “ দেখুন না এতো কথা বলছি কিন্তু পরিচয়টিই হলনা। আচ্ছা, আমি নন্দিনী চক্রবর্তী। মালদা সরলা স্কুলে অ্যাসিট্যান্ট টিচার।। মাত্র দুইবছর হলো আমার চাকুরিসূত্রে এখানে আসা। “ আর আপনি ? এবার দীব্য একটু হেসে বলল,” ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। আর অবসর সময়ে লেখালেখি করি। তবে তেমন কিছুই না!”-“ বেশ তো দীব্যজ্যোতিবাবু। লিখে যান। যানেন, ভগবান সবাইকে এইগুণ দেননা। লেখাটা বন্ধ করবেন না প্লিজ! “ নন্দিনীর কথা শেষ না হতেই হঠাত দীব্য অবাক ভাবে বলে, “ আপনার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে না?“ “ ও কিছুনা! অটো থেকে নামবার সময় তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে একটু কেটে গেছে। “ দাঁড়ান”, বলেই ব্যাগ থেকে ব্যান্ডেডটি বের করে দিব্য তাকে দিল।
নন্দিনী দীব্যর দিকে তাকিয়ে বলে, কফি খাবেন?” হুম, দিন। বাইরে যা বৃষ্টি!!” কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে নন্দিনী দীব্যর দিকে তাকিয়ে বলে, “ জানেন,মানুষের জীবনটি না অনেকটা নাগরদোলার মতো। যত উপরে যাই দূরের মানুষগুলোকে দেখতে পাই। আর কাছে এলে সেই পরিচিত মুখগুলো.... । “দীব্য কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। এদিকে ট্রেন জোরে জোরে জোরে হুইসেল বাজিয়ে চলেছে। “ আমায় এবার নামতে হবে দীব্যজ্যোতিবাবু। ভালো থাকবেন। সত্যি আপনি খুব ভালো! আপনাকে দেবার মতো কিছুই নেই। এই কলমটি দিলাম। ভালো ভালো কবিতা লিখবেন।“ দীব্য ডায়েরীর পাতাটি ছিঁড়ে কবিতার কয়েকটি লাইন লিখে নন্দিনীর হাতে তুলে দেয়। “ নন্দিনী নেমে পড়ে পরের স্টেশনেই।
ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দিল। নন্দিনী তাকিয়ে থাকে জানালার দিকে। ধীরে ধীরে দীব্য মিশে যাচ্ছে সেই শহরের কৃত্রিমতায় সকলের ভিড়ে। আজ যেন তার গলাটি খুব শুকিয়ে আসছে। ব্যাগ থেকে জলের বোতলটি বের করতেই নজরে আসে দীব্যর লেখা সেই ডায়েরীর পাতাটি,তার লেখা ‘প্রাক্তণ’,কবিতার কয়েকটি লাইন,
“জানালার পাশ দিয়ে চেয়ে থাকি,
সেই তো গাছ, সেই চেনা বাড়ি
সেই ব্যস্ত স্টেশন..
শুধু আজ সে হয়ে গেল
প্রাক্তন.....”
-দীব্যজ্যোতি মুখার্জী, ২৭শে আষাঢ়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct