ভোপাল বিপর্যয়
নায়ীমুল হক
____________
অনেকক্ষণ থেকে ইকো পার্কের একবার বাঁ দিকে, আর একবার উল্টো দিকে পাক দিচ্ছিল জোহানদের একদম ব্র্যান্ড নিউ গাড়িটা, টয়োটা হাইলাক্স। এক সপ্তাহ হল জোহানের দাদা এক বছর ফ্রাংকফুর্টে চাকুরী জীবন পার করেই কিনে ফেলেছে শখের গাড়ি। উইকএন্ড-এ আজ ভাইয়ের বন্ধুদের ইকো পার্কের কাছে ড্রপ করে তাকেও দ্রুত সারতে হবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অফিশিয়াল কাজ, আবার সন্ধ্যের আগে এদেরকে নবাবপুর থেকে তুলে নেওয়ার কথা। ইউসুফ ফোন করে তিস্তাকে, ঈষৎ রাগের স্বরে, কোথায় তোদের বাড়ি! কেউ বলতে পারছে না!
তিস্তাও ছাড়ার বান্দা নয়। বলে ওঠে, যদি তাই হবে, আকাশ পৌঁছল কীভাবে!
ছাড়, ওসব তর্ক। কাউকে জিজ্ঞেস কর, ইকো পার্কের 10 নম্বর গেট, ঠিক তার উল্টো দিকের রাস্তা ধরে মিনিট দুয়েক এসে বাঁদিকের দ্বিতীয় বাড়ি। আর তাছাড়া ড্রাইভার আঙ্কেলকে তো লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছি।
ওহো, তাইতো। আঙ্কেল তোমার ফোনে লোকেশন আছে, ওটা একটু চালিয়ে নাও।
মিনিট খানেকের মধ্যে ওরা খুঁজে পেল নবাবপুরের মোড়, সেখান থেকে তিস্তাদের বাড়ি পৌঁছতে আর দুমিনিট।
হই হই করে উঠলো সবাই -- তিস্তা, জোহান, কবীর, আকাশ, ইউসুফ সকলে।
তিস্তা জোহানের দাদাকে চা খেয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো।
না গো, অনেকটা দেরি করে ফেলেছি, সন্ধ্যায় দেখা যাবে। এখন তোমরা মজা করো।
****
তিস্তার বাবা সকলকে ঘরে আসতে বললেন। ঘরে ঢুকেই সকলে চমকে উঠল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে তাকিয়ে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ধ্রুবজ্যোতি বাবু তো।
তিস্তার বাবা বললেন আমার বিশেষ বন্ধু অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়। ইউসুফ বলে উঠলো, কাকু আমরা ওনাকে চিনি। অ্যামিটি ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন, বর্তমানে সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটিতে আছেন ।
জোহানের সংযোজন আমার দিদি তো ওনার আন্ডারে পিএইচ ডি করেছে, বায়োটেকনোলজিতে।
তিস্তার বাবা বললেন, বাহ্ তোমরা অনেকটাই খোঁজ রাখো দেখছি, বেশ।
ধ্রুবজ্যোতি বাবু বললেন, বাইরে থেকে এসেছো, তোমরা ঠিকমত স্যানিটাইজ করে নিয়েছো তো?
সকলে মাথা নাড়লো। হ্যাঁ কাকু, এসে আমরা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিয়েছি।
তিস্তা এবার একে একে চারজনকে পরিচয় করিয়ে দিল ধ্রুবজ্যোতি কাকুর সঙ্গে।
তিস্তার বাবা বললেন প্যানডেমিক-এর কারণে অনেকদিন তোমরা দেখা সাক্ষাৎ করতে পারোনি, এবার তাহলে কথা বলো, আমরা একটু আসছি।
কথা শেষ না হতেই ফস করে আকাশ বলে ওঠে, কাকু, ধ্রুবজ্যোতি কাকুকে যখন পেয়ে গেছি, তাহলে ওনার কাছ থেকে দু-একটা কথা আমরা শুনতে চাই।
সকলেই একসাথে বলে ওঠে, কাকু, প্লিজ.....
তিস্তা বলে আমরা শেষবার যখন ইউসুফদের বাড়ি সমবেত হয়েছিলাম, কাকিমা আমাদের অনেক মজার মজার সংখ্যা শিখিয়েছিলেন।
কবীর বরাবরই অংকে ভালো, ক্লাস এইট এর ছাত্র। সে বলে, আমার বেশ মনে আছে-- সুখী সংখ্যা, প্যালিন্ড্রোম সংখ্যা, রক্তচোষা সংখ্যা, স্বর্ণালী সংখ্যা...সেদিন আমরা শুনেছিলাম। আজ আমরা কাকুর মুখে তেমনই কিছু শুনতে চাই।
ধ্রুবজ্যোতি বাবু বেশ বুঝলেন সহজে ছাড়ার পাত্র-পাত্রী এরা কেউ নয় ।
সকলকে চেয়ারগুলো কাছাকাছি করে টেনে নিয়ে গোল হয়ে বসতে বললেন।
কাঠের পালিশ করা চেয়ারে সকালের এক ফালি রোদ আরো চকচকে করে দিয়েছে। হাসিখুশি মানুষটি কিন্তু ততক্ষনে যেন এক অন্য মানুষ। চোখ বুঁজে নিমেষে অন্য জগতে চলে গেছেন।
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, জানো তো, আজ 3 রা ডিসেম্বর .....
37 বছর আগে এই দিবাগত রাতে ঘটে গিয়েছিল এক নিদারুণ বিপর্যয়। হয়তো সামান্যই ছিল অসতর্কতা কিংবা অবহেলা। সেই বিতর্কে আজ আর গিয়ে লাভ নেই। কিন্তু তার দায় চোকাতে হয়েছিল বড্ড বেশি, যা বড়ই পীড়াদায়ক। আজও তাড়া করে বেড়ায়।
পকেট থেকে রুমাল বার করলেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু। ঘরে তখন পিন-পতন নীরবতা। সকলেই বেশ বুঝতে পারছে, 1984 সালে ঘটে যাওয়া ভোপাল বিপর্যয়ের দিকে ইঙ্গিত করতে চাইছেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু।
ভারী গলায় শুরু করেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু -- দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে 37 বছর। 1984 সালের 2 ডিসেম্বরের সেই ভয়ঙ্কর রাত।পৃথিবীর ইতিহাস তা কখনও ভুলতে পারবে না । শিল্পদূষণের ফলে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার ভয়াবহতার সাক্ষী তোমরা কেউ নও, কিন্তু তা শুনে নিশ্চয়ই গা শিউরে উঠবে। দায় আর দায়িত্বের কথা আজ আর বলে লাভ নেই, সে দিন ইউনিয়ন কার্বাইডের কারখানা থেকে বেরিয়ে পড়ে বিষাক্ত গ্যাস, মিশে যায় বাতাসে। দ্রুত হাজার হাজার মানুষ ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করে। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল সেদিন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের আইএলও-এর এক সাম্প্রতিক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, 1984 সালে অন্তত 30 টন মিথাইল আইসো সায়ানেট (MIC) গ্যাস বাতাসে মিশে গিয়েছিল ইউনিয়ন কার্বাইডের রাসায়নিক কারখানা থেকে। জলে মিশে গিয়েছিল পারদ, বেঞ্জিন হেক্সাক্লোরাইড-এর মতো বিষাক্ত রাসায়নিক। প্রায় ৬ লক্ষেরও বেশি কর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তিন যুগ পরে আজও পুকুরের জলে মিলছে বিষাক্ত গ্যাসের নিঃসরণ।
এর দায় কে নেবে!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct