ফৈয়াজ আহমেদ : রূপকুণ্ড হিমালয়ের একটি ছোট্ট হ্রদ। সাগরসমতল থেকে ১৬,৫০০ ফুট উঁচুতে এর অবস্থান।ভৌগোলিকভাবে রূপকুণ্ড পড়েছে ভারতের উত্তরখণ্ড প্রদেশে, তিব্বতের সীমান্ত এর মাত্র পঁয়ত্রিশ মাইল উত্তরে। মাত্র ১৩০ ফুট চওড়া আর ১০ ফুট গভীর রূপকুণ্ড জনমানবহীন এক অঞ্চলে অবস্থিত। সবথেকে কাছের জনবসতির নাম ওয়ান (Wan)। তা-ও প্রায় পাঁচ দিনের রাস্তা। রূপকুণ্ডের পার্শ্ববর্তী এলাকা কুখ্যাত যখন তখন ওঠা ঝড়ের জন্যে। বছরের বেশিরভাগ সময় তুষারে জমে থাকা পথঘাটও পর্যটকদের বিপদের কারণ। ফলে বহু বছর জনমানুষের আনাগোনা এখানে ছিল না বললেই চলে।
সময়টা ১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। সেই সময় প্রায় শ’খানেক কঙ্কাল আবিষ্কার হলো হ্রদের তলদেশে। সবই মানুষের। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে রূপকুণ্ডের নাম হয়ে গেল স্কেলিটন লেক বা কঙ্কাল হ্রদ। কোথা থেকে এলো এসব কঙ্কাল? কারাই বা এই হতভাগ্য মানুষ? তৎকালীন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা সবকিছুতেই জাজলদের ছায়া দেখতে পেতেন। কাজেই প্রাথমিকভাবে তারা মনে করলেন হিমালয় পার হয়ে ব্রিটিশ এলাকায় অতর্কিতে হামলা চালাতে আসা কোনো জাজল সেনাদল হতে পারে এরা। তবে খুব শীঘ্রই বোঝা গেল- এসব কঙ্কাল এখানে পড়ে আছে কম করে হলেও শ’খানেক বছর। কাজেই কঙ্কাল গুলো কোনো সেনাদল-এর হতেই পারে না।
দেশ বিভাগের পর ১৯৫৬ সালে ভারতের কলকাতার নৃতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (Anthropological Survey of India) রূপকুণ্ডে জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। প্রথম জরিপ বানচাল হয়ে যায় তুষারঝড়ে। দুই মাস পর দ্বিতীয় অভিযানে হ্রদ থেকে বেশ কিছু নমুনা নিয়ে আসা হলো কলকাতায়। কার্বন ডেটিং করে কঙ্কালগুলোর বয়স বের করা হয়। এই পদ্ধতিতে দেখা যায়, এসমস্ত কঙ্কাল ৫০০-৮০০ বছরের পুরনো। উল্লেখ্য, কার্বন ডেটিং তখনও খুব উন্নত ছিল না। এবং কিছু ক্ষেত্রে এর ফলাফল পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
রূপকুণ্ড নিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানী এবং ওয়াকিবহাল মহলেও বেশ আগ্রহ ছিল। অনেকে ধারণা প্রকাশ করলেন, এরা হয়তো কোনো ধর্মীয় আচার পালনের মানসে নিজেদের একসাথে উৎসর্গ করেছে। কারো কারো মত ছিল, এগুলো ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লির সুলতানের পাঠানো তিব্বতে অভিযান চালাতে যাওয়া সেনাদের দেহাবশেষ। এই তত্ত্বের বিরোধিতা করে আরেকদল দাবি করলেন, এরা সেনাসদস্য না, বরং এরা সাধারণ বণিক যারা তিব্বতে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য মতের মধ্যে ছিল রূপকুণ্ড একসময় স্থানীয় বাসিন্দাদের কবর দেয়ার স্থান ছিল অথবা কোনো মহামারীতে মৃত্যুবরণকারীদের দেহ এখানে ফেলে দেয়া হয়েছিল।
অনেক বছর ধরে রূপকুণ্ড পাশ্চাত্যের কাছে অচেনা ছিল। ১৯৭০ সালে উইলিয়াম স্যাক্স নামে নৃতত্ত্বের এক ছাত্র ভাগ্যগুণে কিছু ভারতীয় বই পড়তে গিয়ে রূপকুণ্ডের ব্যাপারে জানতে পারেন। মহা উৎসুক হয়ে এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে তিনি ওয়ানে এসে হাজির হন। স্থানীয় এক গাইড তাদের হ্রদের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর ঝড় ঠেলে স্যাক্স রূপকুণ্ড দেখে এলেন।
রূপকুণ্ড কাহিনী স্যাক্সকে করেছিল শিহরিত। নিজের থিসিসের বিষয় তাই তিনি নির্ধারণ করেন নন্দ দেবীর পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকগাথার বিশ্লেষণ। আশির দশকে পাশ্চাত্যের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে স্যাক্স নন্দ দেবীর তীর্থযাত্রা সম্পন্ন করেন।
স্যাক্স প্রথম রূপকুণ্ড ঘুরে যাবার পর থেকে এখানে পর্যটকদের আগমন বাড়তে থাকে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছিল হ্রদের প্রাকৃতিক পরিবেশ। কোনো পাহারা না থাকায় অনেক দুঃসাহসী পর্যটক জলতে পড়ে থাকা কঙ্কাল নাড়াচাড়া করে দেখেন, ফলে অনেক হাড় স্থানচ্যুত হয়। কেউ কেউ এককাঠি আগ বেড়ে নিজের মনে করে কিছু হাড়গোড় নিয়ে চলে যান।
রূপকুণ্ডের কঙ্কাল জনসমক্ষে আসার পর চালানো হয়েছে বেশ কিছু গবেষণা। এতে প্রমাণিত হয়েছে কঙ্কালগুলো পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের। ফলে সেনাদলের সদস্য তারা হতে পারে না। এদের বয়স ৩৫-৮০ বছরের মধ্যে, এবং তেমন কোনো রোগের সন্ধানও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে পাওয়া যায়নি। ফলে রূপকুণ্ড কবরখানা হিসেবে ব্যবহৃত হত এমন চিন্তাও নাকচ হয়ে গেল। এরা তিব্বতগামী বাণিজ্যদল ছিল এমন ধারণাতেও জল ঢেলে দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানালেন, এই অঞ্চল দিয়ে তিব্বত আর ভারতের মধ্যে কোনোকালে কোনো বাণিজ্যপথের খবর পাওয়া যায়নি। তাছাড়া বাণিজ্য কাফেলা হলে এদের সাথে মালপত্র থাকার কথা? সেই চিহ্ন কই? হ্রদ থেকে কেবল পাওয়া গিয়েছিল চামড়ার জুতা আর নিত্য ব্যবহার্য কিছু জিনিস।
২০০৪ সালে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিকেরা রূপকুণ্ডের কঙ্কালগুলো নিয়ে বড় আকারে পরীক্ষা নিরিক্ষা চালালেন। বেশ কিছু মাথার খুলি পরীক্ষা করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এমন কিছু ক্ষত দেখেন যা শিলার আঘাতে সৃষ্টি হতে পারে। ফলে তাদের তত্ত্ব ছিল সম্ভবত ঝড় আর শিলাবৃষ্টিতে প্রাণ হারিয়েছে।
ততদিনে কার্বন ডেটিং আরো আধুনিক হয়েছে। ফলে নতুন করে বয়স নির্ধারণ করতে নমুনা পাঠানো হয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। টম হিঘাম নামে একজন বিশেষজ্ঞ এই পরীক্ষা করেন। তার রায় ছিল- এই কঙ্কালগুলোর সবই নবম শতকের, যারা একসাথে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছে। ফলে কোনো একটি ঘটনাই সবার মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে বলে মত দেন তিনি।
সব ফলাফল একত্রিত করে বিজ্ঞানীদের এই দল অবতারণা করলেন তাদের তত্ত্বের। তারা জানালেন, সম্ভবত ৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নন্দ দেবীর তীর্থে যাচ্ছিলেন একদল মানুষ। রূপকুণ্ডের উপরের পাহাড়ি পথ পার হতে তাদের সহায়তা করছিলেন স্থানীয় এলাকাবাসী। এমন সময় শুরু হয় তুষারঝড় আর শিলাবৃষ্টি। কাফেলার সবাই মারা পড়ল।। তাদের দেহ চাপা পড়ে যায় বরফে। এরপর কয়েক বছর ধরে তুষারধ্বস তাদের মরদেহ টেনে নিয়ে যায় রূপকুণ্ডের তলে।
২০০৪ সালের গবেষণা পর রূপকুণ্ডের রহস্য মীমাংসিতই মনে হচ্ছিল। কিন্তু নতুন এক গবেষণা একে আরো ঘনিভূত করে তুলল। বছরখানেক আগে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির বিজ্ঞানীরা রূপকুণ্ডের কঙ্কালগুলোর জিনগত বিশ্লেষণ করেন। তাদের অন্যতম ছিলেন ভারতের বীরবল-সাহনি ইন্সটিউটের ডক্টর নিরাজ রাই এবং হার্ভার্ডের ডেভিড রেইখ। তারা ৩৮টি কঙ্কালের ডিএনএ পরীক্ষা করে ২৩ জনকে পুরুষ এবং ১৫ জনকে মহিলা হিসেবে সনাক্ত করেন।
ডক্টর রাই এবং ডেভিড আরো দেখতে পান যে, ২৩টি কঙ্কাল দক্ষিণ এশিয়ান বংশগতির চিহ্ন বহন করছে। এরা সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মারা গিয়েছিল। ফলে আগে যেমন বলা হয়েছিল সবাই একসাথে কয়েক ঘণ্টার মাঝে মৃত্যুবরণ করেছে, ডিএনএ-র ফলাফল তার সাথে দ্বিমত করল। এদের প্রায় এক হাজার বছর পর আরো কিছু মৃতদেহ যুক্ত হয়। এদের একদল পূর্ব এশিয়ার। আশ্চর্যজনকভাবে অপরদল ছিল পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার।
রহস্য জট পাকিয়ে গেল এখানেই। এশিয়ান যারা তারা হয়তো তীর্থযাত্রী হতে পারে। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের লোক এখানে কী করছিল? যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন হিমালয় এলাকার সাথে ভূমধ্যসাগরীয় জনবসতির যোগাযোগের কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তাহলে এরা কী করছিল এখানে? কীভাবেই বা মৃত্যু হলো এতগুলো লোকের? তাদের কঙ্কাল কেনই বা ঠাঁই করে নিল বরফগলা হ্রদের জলর নিচে?
এখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি এসব প্রশ্নের। কাজেই রূপকুণ্ড নিয়ে নানা বৈজ্ঞানিক আর অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব চলছে। এর ফাঁকে ব্যবসা করে নিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানিও, যারা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে আগ্রহী পর্যটকদের নিরপাদে ঘুরিয়ে আনবে কঙ্কাল হ্রদ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct