শৈত্যপ্রবাহ ও কেল্টু
সাঈদুর রহমান লিটন
_______________________
কুয়াশা ভেদ করে হাঁটতে থাকে কেল্টু। ভারী শৈত্যপ্রবাহ চলছে রাস্তায়। কেল্টু কোথায় যাবে কেল্টুর জানা নাই। শুধু জানে পেটে খাবার নাই। খাবার খেতেই হবে তার । খুব খিদে লেগছে কেল্টুর। শীতের দিনে ভৌগোলিক গত কারণেই বেশি শীত পড়ে উত্তরবঙ্গে। হীম ঝরা শীত বরফ হয়ে যাবার মত । রাস্তার আশেপাশে লোকেরা আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করে। আজ ও রাস্তার পাশে অনেকেই আগুন জ্বালিয়ে শীত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। কেল্টু আগুনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । একজন কেল্টুকে ধাঁক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বলে আমরাই আগুন পাইনে আবার তুমি। ধুর হ’, তোর গায়ে গন্ধ, পচা গন্ধ। কেল্টুর গায়ে একটা নোংরা সয়েটার। সেদিন পথে ফেলানো পেয়েছে। সয়েটারের এক হাতা নেই। বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া। সেই পাওয়া সয়েটারটি ময়লা ঝারা দিয়ে গায়ে দিয়েছে। ছেঁড়া হলেও, বেশ গরম। কেল্টু ভাবে বেশ গরম হয় গায়ে দিয়ে। সূর্য ওঠে না বেশ কয় দিন। ধুয়ে দিলে শুকাবে না। গন্ধ থাকলে ও শীত থেকে খানিকটা বাঁচা তো গেল। এই ভেবেই সয়েটার টি গায়ে জরিয়েছে। ধাক্কা খেয়ে কেল্টু আবার হাঁটতে শুরু করে। কোন প্রতিবাদ করে না। কেল্টুদের প্রতিবাদ করতে নেই। প্রতিবাদ করলে বরং মার খেতে হবে। কেল্টুদের পিঠ সরকারি খাস জমির মত, যার তার অধিকার থাকে। এই ভয়ংকর শীতে পিঠে কয়েক ঘা পড়লে আর বাঁচা যাবে না। ভাবতেই আরো দ্রুত হাঁটতে থাকে কেল্টু। পেটের খিদে বেড়েই চলছে। আজ কোথায় খেতে পারবে জানা নেই কেল্টুর। গত রাতেও খাওয়া হয়নি তার। আজ এগারো টা বাজতে চলল।
আর একটু এগুলেই সীতারামপুর বাজার। বাজারে দুইটি ছোট রকমের হোটেল আছে।সেখানে রুটি সিঙ্গারা হয়। হোটেলে দূরের পুকুর হতে কলস ভরে পানি এনে দিলে, বিক্রি না হওয়া রুটি মাঝে মাঝে হোটেল মালিক খেতে দেয়। কয়েকটি বাজার ঘুরে এভাবেই খেয়ে আসছে কেল্টু। শৈত্যপ্রবাহের কারণে মানুষ বাড়ি থেকে খুব একটা বের হচ্ছে না। তাই হোটেল গুলো ভাল চলছে না। মাঝে মাঝে হোটেল বন্ধ রাখছে মালিকেরা। কিন্তু কেল্টুর পেট তো বন্ধ নেই। কে দিবে কেল্টুকে খেতে।
কেল্টু পথেই মানুষ। বারো- তের বছরের কেল্টু, রাস্তায় রাস্তায় কাটায়। সে জানে না কোথায় তার বাড়ি, কোথায় তার ঘর। জ্ঞান অবধি সে রাস্তায়ই থাকে। তার মা বাবা কে তার জানা নেই। কারো হোটেলের উচ্ছিষ্ট খেয়েই চলছে তার দিন। গরম কালে তেমন সমস্যা হয় না। যে কোন জায়গায় শুয়ে রাত কাটানো যায়। যে কোন হোটেলে খাবার পাওয়া যায়। শীত এলেই মরণ। শীত এলে আর রক্ষা নেই। শীতের ছোবল খুব ভয়ংকর ছোবল। পশ্চিমা বাতাস গায়ে সয়না। শরীর জুড়ে কাঁপন আসে। খোলা জায়গায় শোয়া যায়না। কেল্টু ভাবে, আল্লাহ কেন যে এমন শীত দেয়? সব সময় গরম থাকলেই ভাল হয়।
কেল্টু হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের সামনে চলে আসে।
কেল্টুর মনটা আনন্দে ভরে ওঠে হোটেলটি খোলা আছে। হোটেলের চাচা দেখেই কেল্টুকে একটা কলস ধরিয়ে দেয় পানি আনতে। কেল্টু ও খুশি হয় খাবার পাবে বলে।
কেল্টু শীতে কাঁপতে কাঁপতে পানি নিয়ে আসে। হোটেলের চাচা অবিক্রীত একটা রূটি কেল্টু কে দেয়। কেল্টু খুশিতে খেয়ে নেয়। কিন্তু পেট ভরেনা। পেটে আরো রাক্ষুসে ক্ষুধা
জ্বলে ওঠে। কেল্টু নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, তাদের পেট ভরে খেতে নেই। এভাবেই খেয়ে চলে আসছে এই ছোট জীবন টায়। এখনো কুয়াশা কাটেনি। সময় যত গড়াচ্ছে কুয়াশা তত বাড়ছে। শীতের তীব্রতা তত বাড়ছে। বেলা দুইটা গড়িয়ে প্রায় তিন টা ছুঁই ছুঁই। ছোট একটা রুটিতে চলছে সারাদিন। ক্ষুধার জ্বালা এখন আর কেল্টুকে কাবু করতে পারে না। তবে কোন ভাবে খাবার জুটে গেলে ভালই লাগে কেল্টুর। আজকের দিন টা ভালই ছিলই কেল্টুর।
সদরের হোটেল বিলাসীতে বিকেল বেলা থালা বাটি ধুয়ে দিচ্ছিল। এমন সময় এক ভদ্র লোক খাবার অর্ডার দিয়ে খাবার খেতে যেই বসেছেন অমনি একটি কল পেয়ে কোন মত এক মুঠো খেয়ে বাকি খাবার রেখে হোটেল ছেড়ে চলে যান। কেল্টু খাবার গুলো লুফে নেয়। থালা বাটি ধুয়ে হোটেলের এক কোণে বসে পেট পুরে খেয়ে নেয়। অনেক দিন পর পেট ভরে খেল কেল্টু। কেল্টুর মনে আজ অনেক সুখ, অনেক আনন্দ। পেট ভরে খাওয়ার মত আনন্দ কেল্টুর জীবনে খুব একটা আসে না। আর তা যদি হয় বিরিয়ানি আর খাসির রেজালা। কেল্টু একটা সুখের ঢেকুর তুলে।
সন্ধ্যা হয়ে আসে প্রায়। দূর থেকে আযান শোনা যাচ্ছে মাইকে। মাগরিবের আযান। শীত যেন আজ আরো বেশিই পড়ছে। কিন্তু কেল্টুর খুব একটা শীত অনুভব হচ্ছে না।
কেল্টু মনের খুশিতে কুয়াশা ভেদ করে আবার অজানার উদ্দেশ্যে বের হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct