চাদর
এস ডি সুব্রত
_________________
ফেসবুক মানুষের কত হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেয়। কত দূঃখসুখের স্মৃতি চোখের সামনে তুলে ধরে। ঠিক যেন স্বপ্নের মতো । সুমিত আজ ফেসবুকে তার দিদির একটা ছবি দেখে অতীতে হারিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য । মাসতুতো দিদি । কিন্তু নিজের দিদির চেয়ে কোন অংশে কম আদর করেনি । সুমিত ফিরে যায় ত্রিশ বছর পিছনে । সেই সব দিনগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজ । পড়াশোনার জন্য সেদিন মা বাবা ভাই বোন সবাইকে ছেড়ে সুমিত চলে গিয়েছিল রুপালি ইলিশের দেশে । মোহনার মোহন মায়ায় নিজেকে বেঁধে ফেলে । পদ্মা মেঘনা ডাকাতিয়ার তীরে স্বপ্নের বীজ বুনে । একে একে কাটিয়ে দেয় জীবনের আঠার বসন্ত । মোহনার বাঁকের আত্মীয় বন্ধু স্বজনের ভালবাসায় মুগ্ধ হয় সুমিত । চাঁদের দেশে নিজের একটা স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে পায় । ভুলে যেতে থাকে নিজের একান্ত আপনজনদের ছেড়ে থাকার ভীষন যন্ত্রনা । তবে ভাললাগা একদিনে গড়ে উঠেনি । সুমিতের স্পষ্ট মনে আছে তার বাবা যখন প্রথম তাকে সেখানে নিয়ে যায় ,তখন সেখানকার পরিবেশ তার ভাল লাগেনি । পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সুমিতকে বেশ হিমশিম খেয়েছিল । মাসির কাছে পেয়েছিল মায়ের আদর আর ভালবাসা । তবে মাসির আদর ভালবাসা ছাপিয়ে সুমিতের মনে ভীষণ দাগ কাটে একটি ঘটনা । সুমিত প্রথম যখন তার বাবার সাথে চাঁদপুর যায় তখন নভেম্বর মাস । শীত পড়তে শুরু করেছে একটু একটু । সুমিতের বাবা সুমিতকে সেখানে রেখে আসে কিছুদিনের জন্য। যদি ভাল লাগে তাহলে সেখানে স্কুলে ভর্তি হবে । শীত বাড়তে থাকে। ওদিকে সুমিত শীতের কাপড় নেয়নি সাথে । একদিন খুব ঠান্ডা পড়ে । সুমিত ছিল লাজুক ও চাপা স্বভাবের । সহজে মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে চায়না । ঠান্ডায় বেশ জড়সড় হয়ে বসে আছে খাটে । এমন সময় তার দিদি সুহানা আসে তার কাছে । ঠান্ডা লাগছে কিনা জানতে চায়। সুমিত লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারেনি। কিন্তু সুহানা বিষয়টি বুঝতে পারে । ওমনি তার গায়ে থাকা কাশ্মিরী চাদর সুমিতের গায়ে জড়িয়ে দেয় আর বলে দেয় তুই যতদিন না গরম কাপড় আনবি , ততদিন এ চাদর তুই গায়ে দিবি। সুমিত আবাক হয়। সুমিত জানে তার দিদিরও বাড়তি চাদর নেই । সুমিত তার দিদিকে বলে , তাহলে তুমি কি গায়ে দিবে ? তার দিদি সেদিন বলেছিল আমার চিন্তা তোর করতে হবে না । তোকে যেটা বলছি সেটা কর, সুহানার সাফ জবাব । সুমিত যতদিন তার দিদির চাদর গায়ে দিয়েছিল , তার দিদি চাদর গায়ে না দিয়েই ছিল । সত্যি বলতে তার দিদির এমন আদর আর ভালবাসা সেদিন সুমিতকে সেখানে থাকতে সহায়তা করছিল। সেদিনই সুমিত সিদ্ধান্ত নেয় যে , সেখানে থাকবে । মাসখানেক পরে যখন সুমিতের বাবা আবার সেখানে যায় সুমিতকে আনার জন্য তখন সেখানে স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত জানায় তার বাবাকে । পরের সপ্তাহে ভর্তি হয় । বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে। এর পর চাঁদপুর সরকারি কলেজে এইচএসসি থেকে শুরু করে মাস্টার্স কমপ্লিট করে । এর মধ্যে সুমিতের জীবনে বয়ে গেছে অনেক ঝড় ঝাপটা । সকল ঝড় ঝাপটা আর খারাপ সময়ে পাশে ছিল তার দিদি সুহানা । এমনকি তার দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পরও নিয়মিত তার খোঁজ খবর নিতো । পাশে এসে দাঁড়াত । সাহস দিত,উৎসাহ দিত । সুমিতও তার দিদির বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ প্রতি বছর অন্তত একবার যেতো । কখনো নাইওর আনতে , কখনো বেড়ানোর উদ্দেশ্যে । শেষে একবার তার দিদির বাড়ি যাওয়ার পথে লঞ্চে ঝড়ের কবলে পড়লে আর যায়নি সেখানে। কোকো লঞ্চে যেতো সেখানে।
এখন সুমিতের আলমিরা ওয়ারডোব ভরতি জামা কাপড় । শীতের জাম্পার ,সুয়েটার , ব্লেজার , জ্যাকেট এর অভাব নেই । কিন্তু সেদিন একটা চাদরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল এক মাস । অথচ আজ যখন চোখের সামনে যেটা দেখে তখনই কিনে ফেলে। সময় বদলায় ,এটাই দুনিয়ার নিয়ম। তবে স্মৃতি গুলো থেকে যায় আজীবন মনের মনিকোঠায় । সুমিতের দিদি সুহানার সাথে এখন প্রায়শই কথা হয় ফোনে। তবে দেখা হয়না অনেক দিন। একটা চাদরের মাঝে কত স্নেহ মমতা ভালবাসা সেদিন সুমিত অনুভব করেছিল তা আজও ভুলতে পারেনি ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct