জয়প্রকাশ কুইরি : অরণ্যের গন্ধ তাঁর নির্মাণে। তিনি অরণ্যের সন্তান। যার নাম আমজাদ কাজী। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত শুকলাড়া গ্রামের কাজী অবশ্য পুরুলিয়ায় পরিচিত নাম। পেশায় সাংবাদিক নেশায় চিত্র নির্মাতা। তাঁর পরিচালনায় তথ্যচিত্র ‘ড্যান্স অফ দ্যা ফরেস্ট ‘এবার প্রদর্শিত হচ্ছে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। মানভূম এমন এক ভূমি যেখানে কথা বললেই বেজে ওঠে গান, পা ফেললেই ফুটে ওঠে নাচের ছন্দ। কাজীর তথ্যচিত্রে ছোটনাগপুর মালভূমির এমন ১২টি নৃত্যশৈলির হদিশ মিলবে, বিশ্বায়নের দুনিয়ায় যাদের হয় নাভিশ্বাস উঠেছে, নয়তো যারা ইতিমধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছে।
‘মৃতপ্রায় নৃত্যগুলির একটা তথ্য ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। এমন অনেক নাচই রয়েছে যেগুলির কথা কেউ জানে না। হয়তো একজন বা দুজন শিল্পী আছেন, তাদের মৃত্যুর পর সেই শৈলীটাই হারিয়ে যাবে। কালের করাল থাবায় কত ঐতিহ্যই হারিয়ে যায়। ড্যান্স অফ দ্যা ফরেস্ট হয়তো আমাদের স্মৃতিপটে ধরে রাখবে তাদের অস্তিত্বের কথা। বারবার মনে করাবে নিজেদের টিঁকিয়ে রাখতেই এদের পুনরুজ্জীবন কেন দরকার বললেন কাজী। জানালেন,’ নির্মাণ পরিকল্পনা বহুদিন ধরেই ছিল। রিসার্চ ওয়ার্ক করেছেন পুরুলিয়ার প্রখ্যাত লোক গবেষক কিরিটি মাহাতো। শুধুমাত্র টাকার অভাবে এগোতে পারছিলাম না। এক সেমিনারে দেখা হয়ে যায় পুরুলিয়ার ভূমিকন্যা, বর্তমানে কর্মসূত্রে মহারাষ্ট্রের পুনের বাসিন্দা শর্মিলা মজুমদারের সঙ্গে। বিষয়টি তাঁকে জানাই। ‘শর্মিলা দেবী লুফে নেন প্রস্তাব। শুধু যে তিনি নিজে নৃত্যশিল্পী সেই কারণে নয়, নিজের মাতৃভূমির মৃতপ্রায় শিল্পগুলির জন্য কিছু করতে পারার আগ্রহ থেকেই তথ্যচিত্রটির প্রযোজনায় এগিয়ে আসেন তিনি। আমজাদ কাজী বলেন, প্রায় সাত লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে তথ্যচিত্রটি নির্মাণে। ছৌ, নাচনি, নাটুয়ার মতো সুবিখ্যাত ও অল্পখ্যাত নৃত্যশৈলীগুলির পাশাপাশি রয়েছে মাছানি, সরহুল, ডেহেং, শিকার , ঘেরা নৃত্যের মতো প্রায় বিস্মৃত নৃত্যকলা। সবচেয়ে সমস্যায় পড়ি ডেহেং ও শিকার নাচের শ্যুটিং ঘিরে। সারা পৃথিবীতে ডেহেং নাচ জানতেন একজনই ব্যক্তি। পাড়া থানার পাঠকডি গ্রামের মহামাঈ দলের কালিন্দি বুঢ়া। নবতিপর আনন্দ কালিন্দি অশক্ত শরীরে পারতেন না নৃত্যকলা প্রদর্শন করতে। চার মাস ধরে চলে তাঁর শুশ্রূষা। কিছুটা সুস্থ হয়ে, সমর্থ হয়ে আশপাশের কয়েকজন যুবককে তালিম দেন তিনি তারপর শুরু হয় শ্যুটিং।
শিকার নাচ সারা ছোটনাগপুর মালভূমিতে একমাত্র ঝাড়খণ্ডের গঙ্গানারায়ণ শিকার নৃত্যদল এই নাচ জানে। সিংভূমের বড়াম থানার আমজোড়, বুড়িগড়া, কইর্যা, গুমানডি গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গুটিকয় শিল্পীকে এক জায়গায় জড়ো করাটাই ছিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। সেই পরীক্ষায় অবশেষে উতরে গেলাম।
চ্যালেঞ্জ ছিল অন্যত্রও। যে টাকা খরচ হয়েছে, তাতে অনায়াসে প্রফেশনাল ক্যামেরা পার্সনকে দিয়ে কাজ করাতে পারতেন কাজী। কিন্তু তিনি হেঁটেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে পুরুলিয়ার ক্যামেরা পার্সনদের দিয়েই করিয়েছেন কাজ। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে আকাশ বড়াই, অর্ণব গাঙ্গুলি, দীপঙ্কর নাগ, আকাশ কুণ্ডু, রণি দে, টিটু দাস,রোহণ রঘুবংশ, সপ্তর্ষি মাহাতোরা দুর্দান্ত মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অনিমেষ বোসের সম্পাদনা আরও ধারালো করেছে ছবিটি। চিত্রনাট্য এবং সংলাপ রচনা করেছেন সোমা বসু। তীর্থ সুন্দর বিশ্বাস সংগীত নির্মাণের দায়িত্ব সামলেছেন। কাজীর মাস্টারস্ট্রোক অন্য জায়গায়। সারা পুরুলিয়া যাঁকে দুঁদে রাজনৈতিক নেতা ও দক্ষ সংগঠক হিসাবে চেনে, আদিবাসী কুড়মি সমাজের মূল খুঁটি মূল মানতা অজিত প্রসাদ মাহাতোর একটা অন্য পরিচয় হাজির করেছেন তিনি। অজিত বাবুর লেখা ও সুর করা দুটি ঝুমুর এই ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
আমজাদ কাজীর প্রথম তথ্যচিত্র মাওবাদীদের অন্দরমহলের সুলুক সন্ধান তুলে এনেছিল। কোড নেম রেড যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল বিদগ্ধ মহলে পাশাপাশি সরকারী ,বেসরকারী বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছে ডকুমেন্টারী ফিল্মটি.
পরের ছবি ‘ফাইট ফর পুরুলিয়া’ তুলে ধরেছিল প্রাক্তন সাংসদ দেবেন মাহাতো ও কংগ্রেস নেতা নেপাল মাহাতোর সংগ্রামের ইতিহাস। এবারের ছবি আমজাদের নিজের মাটির সংস্কৃতির গন্ধ মাখা। ড্যান্স অফ দ্যা ফরেস্ট সেই অরণ্যের স্পন্দন, যা ছোটনাগপুরের প্রতিটি বাসিন্দার ধমনীতে প্রবহমান
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct